পল্টু ডাকাতের হাত থেকে রক্ষা পেতেই গোয়ালতোড়ের তুতবাড়িতে শুরু সন্ন্যাসীবাবার পুজো
সুদীপ কুমার খাঁড়া
দুর্ধর্ষ পল্টু ডাকাতের আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পেতেই গোয়ালতোড়ের তুতবাড়িতে সন্ন্যাসী বাবার পূজারম্ভ শুরু হয়। ঝোপ-জঙ্গলে ঘেরা তমাল নদীর পাশে চৌতাড় মৌজা। চারিদিকে ধূ-ধূ করা মাঠ আর একপাশে ক্ষীণ শীর্ণকায়া তমাল নদী। সেই তমাল নদীর পাড়ে চৌতাড় মৌজাতে আদি বাসস্থান ছিল গোয়ালতোড়ের মুখ্যাদের। অনেকদিন আগেকার কথা। যেখানে মুখ্যাদের বাড়ি ছিল সেই এলাকায় এক পাশে ছিল ধরমপুর শাঁখাভাঙার জঙ্গল, অন্যদিকে ধূ-ধূ করা মাঠ। সূর্য অস্ত গেলেই চারিদিকে নেমে আসত গভীর নিস্তব্ধতা। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর শিয়ালের হুক্কা-হুয়া। তার মাঝে মুখ্যাবাড়িতে জ্বলত টিম টিম করে রেড়ির তেলের আলো। অবস্থাপন্ন পরিবার হওয়ায় প্রভূত সম্পত্তির মালিক ছিল এই মুখ্যারা।
কথিত আছে সেই সময় গোয়ালতোড় শালবনির এই এলাকায় দাপিয়ে বেড়াত পল্টু নামের এক দুর্ধর্ষ ডাকাত। যিনি রাতের অন্ধকারে হা রে রে করে দলবল নিয়ে এসে নিমেষে গৃহস্থের বাড়ি থেকে সর্বস্ব লুটে নিয়ে রাতের অন্ধকারেই গা ঢাকা দিয়ে দিত। এই পল্টু ডাকাত কোথা থেকেই বা আসত, আর কোথায় যেত তা কারওই জানা ছিল না। কিন্তু পল্টু ডাকাতের নাম শুনলেই সবার থরহরি কম্প শুরু হয়ে যেত।
জঙ্গল আর ধূ-ধূ প্রান্তের সীমায় বসবাসকারী মুখ্যারাও এই পল্টু ডাকাতের ভয়ে কাঁপত। শোনা যায় এক দু’বার নাকি পল্টু ডাকাতের শিকারও হয়েছিলেন তারা। তাই পল্টুর সেই জবা ফুলের মতো চোখ আর লম্বা গোঁফওয়ালা মুখ মুখ্যাদেরও ভাবিয়ে তুলেছিল। তখনই তাদের এক বয়স্ক ব্যাক্তি এই পল্টু ডাকাতের আক্রমণের হাত থেকে নিজেদের সম্পত্তি রক্ষা করতে চৌতাড় মৌজাতে অশ্বত্থ ও তেঁতুল গাছের নীচে সন্ন্যাসীবাবার আরাধনা করার মনস্থির করেন। কিন্তু পুজো করব বললেই তো আর পুজো করা হয়ে ওঠে না। পুজো করবেন কে? অনেক ভেবে-চিন্তে তারা বাইরে থেকে গোয়ালতোড়ে মাঝিদের নিয়ে এসে বসবাস করান এবং তাদের দিয়েই পুজো করান।
মুখ্যারা চৌতাড় মৌজাতে যে স্থানে দেবতার প্রতিষ্ঠা করেন সেই স্থানের নাম দেন তুতবাড়ি। চৌতাড় থেকেই তুতবাড়ি নামকরণ হয়। সেই সময় থেকে এখনও তুতবাড়িতে প্রতি বছর মাঘ মাসের ৫ তারিখে নিষ্ঠাসহকারে সন্ন্যাসীবাবার পুজো হয়ে আসছে। যদিও আদি বাসস্থান ছেড়ে পরবর্তী কালে মুখ্যারা গোয়ালতোড়ে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন।
মুখ্যাদের বর্তমান প্রজন্মের দীপক বিষই জানান, “মুখ্যাদের প্রথম কে এখানে বসবাস শুরু করেছিলেন তা জানতে পারিনি। তবে স্বর্গীয় অবনী ভূষণ বিষই, বিনোদ বিষই প্রমুখরা এই পুজোর দেখভাল করেছেন পরবর্তী কালে। কিন্তু শোনা যায় সন্ন্যাসীবাবার পুজো শুরু হওয়ার পর থেকেই পল্টু ডাকাতের উপদ্রব অভূতপূর্ব ভাবে কমে যায়!”
সন্ন্যাসীবাবার বর্তমান সেবাইত সনাতন লোহার জানান, “আমাদের পুর্বপুরুষ নারায়ণ লোহার পুজো করেছিলেন। পরে বংশপরম্পরায় আমার বাবা জ্যোতি লোহার করতেন। তিনি গত হওয়ার পর আমি করছি।”
বাবার সন্তুষ্টির জন্য গাঁজা আর নতুন মাটির হাড়িতে আতপ চাল দুধ, ঘি আর চিনি দিয়ে তৈরি করা ক্ষীর ভোগ দিতেই হয়। আর প্রসাদ বলতে আতপ চালের সঙ্গে চিড়ে-বাতাসা। দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই নিজেদের মনষ্কামনা পূরণের আশায় এখানে এসে পুজো দেন।
প্রতিবছর ৫ মাঘ তুতবাড়িতে সন্ন্যাসীবাবার পুজোর পাশাপাশি মেলাও বসে। কয়েক ঘণ্টার জন্য এই মেলাতে প্রচুর জনসমাগম ঘটে। স্থানীয় বাসিন্দা দীপক বিষই জানান, “এক সময় গোয়ালতোড় এলাকায় তুতবাড়ির মেলার প্রচুর নাম ডাক ছিল। সকাল থেকেই অসংখ্য ভক্ত পুজো দিতে আসতেন। বসত হরেক রকমের পসরা। সবজি, থেকে হাঁড়িকুঁড়ি, মিষ্টির দোকান প্রভৃতি। কিন্তু কালের নিয়মে সেই জৌলুস এখন কিছুটা হলেও কমেছে। পসরার চাপ আর সেরকম নেই। কিন্তু গোয়ালতোড়ের ঐতিহ্যবাহী এই তুতবাড়ির পুজো ও মেলা এখনও গোয়ালতোড়বাসীকে তাদের পুরনো স্মৃতি উসকে দেয়।”
Comments are closed.