প্রয়াত শ্রমিক নেতা ও রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শ্যামল চক্রবর্তী
শুভাশিস মণ্ডল
প্রয়াত হলেন বর্ষীয়ান শ্রমিক নেতা ও রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শ্যামল চক্রবর্তী। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। রেখে গেলেন একমাত্র কন্যা অভিনেত্রী ঊষসী চক্রবর্তীকে। বৃহস্পতিবার বেলা ১.৪৫ মিনিট নাগাদ বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই বর্ষীয়ান শ্রমিক নেতা। কিডনির সমস্যায় ডায়ালিসিস চলছিল তাঁর। প্রথমে শ্যামলবাবু উল্টোডাঙার একটি নার্সিংহোমে ভর্তি হন জ্বর নিয়ে। সেখানে গত ৩০ জুলাই করোনায় আক্রান্ত হন তিনি। এরপরই বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয় তাঁকে। শ্বাসকষ্টের সমস্যা থাকায় অক্সিজেন সাপোর্টে ছিলেন তিনি। ৩ তারিখ থেকে ভেন্টিলেশনে থাকার পর আজ সকালের দিকে দু’বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় তাঁর। এরপরই দুপুরের দিকে মৃত্যুর খবর আসে শ্যামল চক্রবর্তীর।
বাবার মৃত্যুর পর স্মৃতিচারণায় মেয়ে ঊষসী চক্রবর্তী সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘আমার মা মারা যাবার পর খুবই কষ্ট করে আমাকে মানুষ করেছেন৷ কখনও নিজের সিদ্ধান্ত আমার ওপর চাপিয়ে দেননি বাবা৷ দল আর আমিই ছিলাম তাঁর কাছে প্রধান৷’’
শ্যামল চক্রবর্তীর জন্ম পূর্ববঙ্গে ১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। বাবা সুশীল চক্রবর্তী, মা অন্নপূর্ণা দেবী। বিবাহ করেছিলেন পার্টিকর্মী শিপ্রা ভৌমিককে। ১৯৮২-এ প্রয়াত হন শিপ্রা। অভিনেত্রী ঊষসী চক্রবর্তী শ্যামল-শিপ্রার সন্তান।
পূর্ববঙ্গ থেকে আসা অবিভক্ত যৌথ পরিবারে তাঁর ছোটবেলা খুবই দারিদ্রের মধ্যে কেটেছে। ওপার বাংলা থেকে এসে প্রথমে চাকদায় কিছুদিন থাকার পর দমদমের নলতা রোডে তাঁর পরিবার বসবাস শুরু করে। ১৯৫১ সালে তিনি দমদম রায়বাহাদুর বৈদ্যনাথ ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। ১৯৫৯ সালে স্কুল ফাইনাল পাস করেন। স্কুলে পড়ার সময়েই বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৫৯ সালের শেষদিকে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। তারপর দমদম মতিঝিল কলেজে থেকে ১৯৬২-তে ইন্টারমিডিয়েট পাস। এরপর বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে স্নাতক ১৯৬৬-তে। ১৯৭০-এ এসএফআই গঠিত হলে রাজ্য নেতৃত্বে ছিলেন শ্যামল চক্রবর্তী। ১৯৭৩ সালে শিবপুর সম্মেলেনে এসএফআই-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে এসএফআই-এর সর্বভারতীয় যুগ্ম-সম্পাদক হন।
১৯৭৮ সালে শিশির মঞ্চে অনুষ্ঠিত রাজ্য সম্মেলন থেকে তিনি পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ সালের রাজ্য সম্মেলনের পর পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন। ২০০২ সালে হায়দরাবাদ পার্টি কংগ্রেসে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
Comrade @mishra_surjya, @samik_lahiri paid their last respect to Comrade Shyamal Chakraborty. Today the working class and the left movement in the country has lost an important voice. pic.twitter.com/EJhXUDoNc3
— CPI(M) WEST BENGAL (@CPIM_WESTBENGAL) August 6, 2020
১৯৮১ সালে মানিকতলা বিধানসভার কেন্দ্রের উপনির্বাচনে সিপিআই(এম) প্রার্থী হিসেবে প্রথমবার বিধায়ক নির্বাচিত হন শ্যামল চক্রবর্তী। ১৯৮২ সালে পুনরায় জয়লাভ করে রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী হন। এরপর ১৯৮৭ ও ১৯৯১-তেও মানিকতলা থেকে বিধানসভায় জয়ী হন। পরে ১৯৯৬ সালে পরাজিত হন মানিকতলা কেন্দ্র থেকেই। রাজ্যসভা সাংসদ হন ২০০৮-এ।
মৃত্যুর খবর পেয়ে সিপিএম পলিটব্যুরোর সদস্য তথা রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “আমাদের পার্টির প্রবীণ নেতা কমরেড শ্যামল চক্রবর্তীর বেলা দুটো নাগাদ জীবনাবসান হয়েছে। পর পর দু’বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। প্রথম অ্যাটাকের পর কিছুটা সামলে নিলেও দ্বিতীয় আ্যটাকের পর সব শেষ হয়ে যায়। যেহেতু উনি কোভিড পজিটিভ ছিলেন সেই কারণে ওঁর শেষ যাত্রার কর্মসূচি পরে জানানো হবে। আমাদের সব পার্টি অফিসে দলীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে।’’
পিয়ারলেস থেকে শেষ যাত্রায় কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী
কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী লাল সেলাম। কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী অমর রহে। pic.twitter.com/jdPCNiigvL
— CPI(M) WEST BENGAL (@CPIM_WESTBENGAL) August 6, 2020
শ্যামল চক্রবর্তীর মৃত্যুর খবর পেয়ে শোকজ্ঞাপন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ট্যুইটে মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, “সিপিআই (এম) নেতা, সাংসদ, বাংলার প্রাক্তন মন্ত্রী শ্যামল চক্রবর্তীর মৃত্যুতে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি। আমি তাঁর পরিবার-পরিজন ও অনুরাগীদের আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।”
Saddened at the passing away of veteran leader, former Member of Parliament and former Bengal minister Shyamal Chakraborty. My condolences to his family, friends and supporters
— Mamata Banerjee (@MamataOfficial) August 6, 2020
শ্যামলবাবুর মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন দীর্ঘদিনের সহকর্মী বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। শোকবার্তায় বিমান বসু বলেছেন, ‘‘বড় ভাল ব্যবহার ছিল। আমার মা যাদের ভালবাসতেন বাড়িতে গেলে, শ্যামল তাঁদের অন্যতম।’’
শোকপ্রকাশ করেছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা প্রবীণ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান। তিনি জানিয়েছেন, “রাজনৈতিক বিরোধিতার মধ্যেও সম্পর্ক অটুট ছিল। রাজ্যে বর্তমান অবস্থায় সোমেন মিত্র এবং শ্যামল চক্রবর্তীর চলে যাওয়া বাম কংগ্রেসের জোটের জন্য ক্ষতি হল।… যখন মন্ত্রী ছিলেন তখনও বিরোধীদের মর্যাদা দিতেন ও কথা শুনতেন তিনি। অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।”
শোকবার্তায় কংগ্রেস নেতা তথা বহরমপুরের সাংসদ অধীর রঞ্জন চৌধুরী জানিয়েছেন, “কমিউনিস্ট নেতা শ্যামল চক্রবর্তীর মৃত্যু আমাকে অত্যন্ত বেদনাহত করল, তিনি প্রকৃত অর্থে একজন জনদরদী শ্রমিক নেতা ছিলেন। আপাদমস্তক ভদ্র ও মধুর স্বভাবের মানুষ। তাঁর স্বজন হারানো পরিবারের সকলের জন্য সমবেদনা জানাই।”
Comments are closed.