‘তুম মুঝে না ভুল পায়েঙ্গী’
সুদীপ চট্টোপাধ্যায়
আসমুদ্র হিমাচল তাঁর কণ্ঠস্বরে আজও মুগ্ধ হয়ে আছে। তিনি বলিউডি ছবির সংগীত জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মহম্মদ রফি। জনপ্রিয়তায় থাকা অবস্থায় ১৯৮০-র ৩১ জুলাই হঠাৎই স্তব্ধ হয়ে যায় তাঁর কণ্ঠস্বর। মৃত্যুর এত বছর পরও আজও ভুলতে পারেননি তাঁকে তাঁর ভক্তরা, সত্যিই তাঁকে ভোলা যায় না। এমনকী কালের পরিবর্তনে ধূসর হয়ে যায়নি তাঁর দরাজ কণ্ঠস্বর, সুরের আকাশে তাঁর সুর যেন মখমলের বিছানা পেতে রেখেছে। ধ্রুপদী সংগীত থেকে পাশ্চাত্য মিউজিক– সবেতেই তিনি ছিলেন সাবলীল। তাই তাঁকে ছাড়া বোধহয় ভারতীয় চলচ্চিত্র জগৎ যেন অপরিপূর্ণই থেকে যায়।
১৯২৪-এর ২৪ ডিসেম্বর অমৃতসরের কাছে কোটলা সুলতান গ্রামে এক সাধারণ পরিবারের জন্ম। বাবা হাজি আলির ছয় সন্তানের মধ্যে পঞ্চম সন্তান রফি। ছোট থেকেই ফকিরদের সঙ্গে গান গাইতেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি জনসাধারণের সামনে অনুষ্ঠান করে প্রশংসা পান। এরপর লাহোরের একটি নামকরা জলসায় গাইবার সুযোগ পান। সেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় প্রবাদপ্রতিম শিল্পী কে এল সায়গলের। এরপরই জীবনের মোড় ঘুরে যায় রফির।
১৯৪১-এ লাহোরে ‘গুল বালোচ’ ছবিতে প্রথম প্লেব্যাকের সুযোগ পান তিনি। ১৯৪৪ থেকে শুরু হয় তার মুম্বইয়ের (অধুনা বম্বে) জীবন। ১৯৪৫ সালে ‘গাও কি গোরি’ ছবিতে রফি প্রথম সুযোগ পান। সেসময় গানের সঙ্গে দু-একটি ছবিতে ছোটখাটো ভূমিকায় অভিনয়ও করেছেন তিনি। বলিউডের স্বর্ণযুগের সংগীত পরিচালকরা ভুল করেননি তাঁর প্রতিভা চিনতে। এরপর হিন্দি ছবিতে শুরু হয় রফি যুগ। পাঁচের দশকে তাঁর ও প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক নৌশাদের যুগলবন্দি রাতারাতি ঝড় তোলে হিন্দি ছবির আকাশে-বাতাসে। নৌশাদের সুর ও রফির সুরেলা কণ্ঠ মাতিয়ে দিয়েছিল গোটা বলিউড। এরপর রফি জুটি বাধেন সুরকার শঙ্কর জয়কিষণের সঙ্গে। শঙ্করের সুর ও রফির ক্লাসিক্যাল ভয়েস বলিউডি ছবিতে জন্ম দিয়েছিল নতুন এক ঘরানার। রফির ছ’টা ফিল্মফেয়ার পদকপ্রাপ্তির মধ্যে তিনটি ছিল শঙ্কর জয়কিষণের সংগীত পরিচালনায়। এই সময় রফির গলায় রাজেন্দ্র কুমার ও শাম্মী কাপুরের লিপে একটি গান যেন একেকটি বলিউডি ছবির মাইলস্টোন।
তবে আমজনতা রফির গলাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছেন এভারগ্রিন দেব আনন্দের লিপে। দেব সাহেবের জন্য বেশকিছু ছবিতে প্লে-ব্যাক করেছেন রফি সাহাব। আবার বলিউডের ট্র্যাজিক হিরো দিলীপকুমার বা গুরু দত্তের গলাও বারবার কেঁদে উঠেছে তাঁর গানের জাদুতেই। এরপরে ধর্মেন্দ্র, জীতেন্দ্র, শশী কাপুর, এমনকী ঋষি কাপুরের ঠোঁটেও জীবন্ত হয়ে ওঠে তাঁর কণ্ঠ। দেব আনন্দ থেকে রাজেশ খান্না কিংবা ধর্মেন্দ্র থেকে অমিতাভের মতন সব প্রজন্মের সুপারস্টারদের জন্য বারবার গেয়ে উঠেছে রফির সুমিষ্ট কণ্ঠ। কিংবদন্তি সুরকার আর ডি বর্মণের সুরে তাঁর গাওয়া ‘ক্যায়া হুয়া তেরা ওয়াদা’– এই গানটির জন্য পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। ছয়বার পেয়েছেন ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। আর পেয়েছেন অগণিত মানুষের ভালবাসা।
খ্যাতির মধ্যগগনে থাকাকালীন ১৯৮০-র ৩১ জুলাই হঠাৎই থেমে যায় তাঁর গলা। অসংখ্য মানুষকে কাঁদিয়ে চিরতরে চলে গেলেন সদাহাস্যময় এই মহান শিল্পী। তাঁর শেষযাত্রায় বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সেদিন বম্বের রাজপথে নেমেছিল সহস্রাধিক ভক্তকুল। যা এখনও পর্যন্ত একটি রেকর্ড। এই মহান শিল্পীর মৃত্যুর চার দশক পরেও তাঁকে ভুলতে পারেনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম। শিল্পী চলে গেলেও বেঁচে থাকে তাঁর অমর সৃষ্টি। রফি সাহাব বেঁচে আছেন তাঁর গানের মধ্যে দিয়েই যুগের পর যুগ ধরে। তাই আর একজন মহম্মদ রফি আর কি কখনও পাওয়া যাবে? বোধহয় না।
ছবি ঋণ : ইন্টারনেট
Comments are closed.