Bengal Fast
বিশ্ব মাঝে বাংলা খবর

কালান্তরের পথিক, উজ্জ্বল রেনেসাঁ– উৎপল দত্ত

সুদীপ চট্টোপাধ্যায়

উৎপলরঞ্জন দত্ত- আপামর দেশবাসীর কাছে যিনি উৎপল দত্ত (Utpal Dutta) নামেই অধিক পরিচিত। উৎপল দত্ত, এই নামটা একটা যুগের ধারক ও বাহক। ফিল্মিজগতের কাজের সঙ্গে তিনি করে গেছেন একটার পর একটা সফল নাটক। সেই মঞ্চ কাঁপানো নাটক সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করেছে বাংলা নাট্যজগৎকে।

পণ্ডিত, মেধাবী, বিচক্ষণ এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় এই মহানশিল্পীর মৃত্যুদিনে তাঁকে নিয়ে দু’চার কথা লেখার ধৃষ্টতা দেখানোর লোভ সম্বরণ করতে পারছি না। যদিও উৎপলবাবুকে মহানশিল্পী বললে উনি বিরক্ত বা কুণ্ঠিত হতেন। বলতেন– “আমি শিল্পী নই, আমি একজন Agitator, একজন রাজনৈতিক প্রচারক, একজন Propagandist”।

তবু আমরা তাঁর শিল্পীসত্ত্বাকে কোনওভাবেই অস্বীকার করতে পারি না। উৎপল দত্ত সিনেমা এবং নাটক, এই দুই বিনোদন মাধ্যমেই পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে অভিনয় করে গেছেন দাপটের সঙ্গে। অসামান্য অভিনয়ের নিরিখে খ্যাতির শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছেন। কিন্তু যেহেতু মাত্র চোদ্দো বছর বয়েসেই কিশোর উৎপল ঠিক করে ফেলেছিলেন যে উনি জীবনে একজন পেশাদার অভিনেতা হবেন, তাঁর চিন্তাভাবনা-স্বপ্নসাধনা ছিল একমাত্র নাটক আর নাটক- আমিও তাই শিল্পীর প্রয়াণ দিবসে আমার আলোচনা মূলত তাঁর নাটক এবং নাট্যভাবনাতেই সীমাবদ্ধ রাখলাম।

১৯২৯ সালের ২৯শে মার্চ বাংলাদেশের বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন উৎপল দত্ত। বাবা গিরিজারঞ্জন ইংরেজ সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা হওয়ার সুবাদে পুরোপুরি সাহেবি কায়দায় বড় হয়েছিলেন ছোট্ট উৎপল। শিলং আর বহরমপুরে যথাক্রমে শৈশব আর বাল্যকালের কিছুটা কাটিয়ে তিনি দশ বছর বয়েসে যখন কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্সে নবম ক্লাসে ভর্তি হন, তখন জার্মানির পোলান্ড আগ্রাসনের মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজেই ফাদার উইভারের পরিচালনায় কিশোর উৎপলের প্রথম নাটকে অভিনয়। শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’ নাটকে দ্বিতীয় কবর খনকের ভূমিকায় অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দেন তিনি। আর তাই কিশোর উৎপল ওই বয়েসেই স্থির করে ফেলেন- অভিনয়ই হবে তাঁর জীবনের একমাত্র পেশা। নাম লেখালেন ইংল্যান্ডের বামিংহাম থেকে ভারতে আসা ‘শেক্সপিয়ারানা ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার কোম্পানি’ নামে এক পেশাদার থিয়েটার দলে। ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ নাটকে অ্যান্টনিও-র ভূমিকায় অভিনয় দিয়ে শুরু হল ওনার পেশাদার নাট্যজীবন। গুরু হিসেবে পেলেন দলপতি জেফ্রি কেন্ডেলকে। টানা দুই বছর দলের সঙ্গে থেকে সারা ভারত ঘুরে শিখলেন নাটক ও মঞ্চের বিভিন্ন পাঠ। পরবর্তীকালে যাত্রায় যোগদান করার পরে এই পেশাদারিত্ব তিনি যাত্রাদলে প্রথম প্রবর্তন করেছিলেন সকল শিল্পীদের মধ্যে।

যাই হোক এই ইংরেজি নাটক করতে করতেই তিনি মার্কসবাদ, লেনিনবাদ আত্মস্থ করেন। আর তখনই উপলব্ধি করেন যে আপামর বঙ্গবাসীর কাছে এই মহান মতবাদ তাঁকে পৌছে দিতে হবে বাংলা নাটকের মাধ্যমেই। সলিল চৌধুরীর হাত ধরে এই পুরোদস্তুর সাহেব যোগ দিলেন আইপিটিএ-তে।এরপর বাকিটা ইতিহাস। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হলেও মাত্র ২০ বছর বয়সেই তিনি বাংলা নাটকের কিংবদন্তি সব স্রষ্টা- কবি মাইকেল, গিরিশ ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র, নবীনচন্দ্র সেন এমনকী যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত বারংবার পাঠ করে ফেলেছেন আর শিশির ভাদুড়ি ও মহেন্দ্র গুপ্তের অসামান্য সব অভিনয় বার বার দেখেছেন বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তাই বাংলা নাটক পানু পালের ‘ভাঙা বন্দর’-এ স্মাগলার গজাননের ভূমিকায় প্রথম অভিনয়েই সকলকে তাক লাগিয়ে দেন। এভাবে কিছুদিন এর-ওর লেখা বাংলা নাটকে অভিনয় ও পরিচালনা করলেন। কিন্তু অচিরেই বুঝতে পারলেন নিতান্ত বিনোদন নয়- নাটকের মধ্যে দিয়ে মানুষের জন্যে মঙ্গলময় বার্তা এবং নির্দিষ্ট মতবাদ তাঁকে পৌছে দিতেই হবে, এ তাঁর আশু কর্তব্য। নেহাত ভাল নাটক হাতের কাছে না পেয়ে নিজেই কলম ধরলেন উৎপল দত্ত। নাটকের দল বানিয়ে শুরু করলেন নাটক লেখা। নাটকে যেটুকু লেখা থাকে তার বাইরের রাজনৈতিক, সামাজিক জীবনকে নাটকে এনে ফেলা সম্ভব হল বাংলা লিটল থিয়েটারে। এই বিশ্বাস থেকে নিজের দলের নাম রাখলেন ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ যা সংক্ষেপে ‘এলটিজি’ নামে খ্যাত।

উৎপল দত্তের নাটক পুরোপুরি রাজনৈতিক, বামপন্থী বিশ্বাসে সিঞ্চিত। তবু তাঁর মধ্যে এমন ড্রামা আছে, নাটকের গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অবিসংবাদী দক্ষতা আছে এবং বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণী অভিনয়ের ম্যাজিক আছে যে, কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ সর্বত্র সর্বশ্রেণির মানুষ উৎপল দত্তের নাটককে গ্রহণ করল। সত্যদ্রষ্টা নাট্যকার উৎপল দত্ত সমসাময়িক ঘটনা ছাড়াও সারা পৃথিবীর ইতিহাস ঘেঁটে, পুঁথির পর পুঁথি পড়ে বের করতে লাগলেন অত্যাচারিতের ইতিহাস, অত্যাচারীর ছলচাতুরি, দেশাত্মবোধের গল্প। তারপর নিজের গভীর জীবনদর্শন ও অবশ্যই মার্কসীয় তত্ত্বে সেসব জারিত করে সহজপাচ্য নাটক নাটকীয়ভাবে মনোগ্রাহী করে সাধারণ দর্শকদের কাছে পরিবেশন করতে লাগলেন। প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ করে তা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে লাগলেন আপামর বঙ্গবাসী। ‘প্রফেসর মামলক’, ‘মানুষের অধিকারে’, ‘অঙ্গার’, ‘টিনের তলোয়ার’, ‘ব্যারিকেড’, ‘কল্লোল’, ‘সন্ন্যাসীর তরবারি’-র মতো সব নাটক তিনি লিখেছেন এবং করেছেন তাঁর দলকে দিয়ে।

- Sponsored -

প্রসেনিয়াম ড্রামার পাশাপাশি লৌহমানব, দুঃস্বপ্নের নগরী, ফেরারি ফৌজ-এর মতো টানা পঞ্চাশেরও বেশি সরাসরি রাজনৈতিক নাটক লিখেছেন উৎপল দত্ত। সেগুলিও সমান জনপ্রিয় ছিল। তারপর যাত্রাজগতে ঢুকে সেখানেও তিনি একের পর এক- ‘ঝড়’, ‘রাইফেল’, ‘তুরুপের তাস’, ‘সমুদ্রশাসন’, ‘যুদ্ধংদেহী’, ‘সাদা পোষাক’ এইসব অসামান্য পালা লিখে দর্শকের মন জয় করে নিয়েছিলেন। আসলে দর্শকের মেধা আর রুচিকে উৎপলবাবু যথেষ্ট সম্মান করতেন। তিনি কখনওই বলতেন না যে দর্শক এখনও তৈরি হয়নি ভালো জিনিস গ্রহণ করতে। বরং তিনি বিশ্বাস করতেন দর্শক পয়সা দিয়ে হলে ঢুকেছে, তার কোনও দায় নেই খারাপ বা দুর্বোধ্য জিনিসকে ভালো বলার। উলটে নাট্যকারের দায় ও দায়িত্ব দর্শকদের মনোরঞ্জন করানোর পাশাপাশি ভাবতে শেখানোর কথা বলতেন তিনি।

আদ্যন্ত বামপন্থী ও মার্কসবাদে অনুপ্রাণিত এই নাট্যকর্মী মনে করতেন নাটক ও রাজনীতির অর্থই গণনাট্য। রাজনীতি ছাড়া নাটক হতে পারে না। অরাজনৈতিক নাটক বলে কিছু নেই। আর একটা কথা যা তিনি বার বার বলেছেন, সেটা হল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অভিনয়। কী রকম ব্যাপারটা- বেশিরভাগ অভিনেতারা আবেগ নির্ভর অভিনয় করেন, যেটা অনুচিত। বিশ্লেষণী অভিনয়ই আসল অভিনয়।

আর একটা ব্যাপারেও তিনি বেশ ব্যাতিক্রমী মন্তব্য করেছেন ওই বৈজ্ঞানিক অভিনয়ের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। আমরা বলি না- অমুক অভিনেতা ফাটিয়ে দিয়েছেন, তমুক অভিনেত্রী মঞ্চ কাঁপিয়ে অভিনয় করলেন। সাধারণ বুদ্ধিতে এটা অভিনেতার বিশেষ প্রতিভা হিসেবে গণ্য হলেও উৎপলবাবু মনে করতেন এই ধারণা ভুল। শুধু ভুল নয়, মহাভুল। কেন? ওনার বক্তব্য– নাটক মানে তো শুধুমাত্র অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয় নয়। আলোকসম্পাত, মিউজিক, মঞ্চসজ্জা এই ক্ষেত্রগুলোও সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু অভিনেতার অভিনয়ের দাপটের চোটে দর্শকদের ক্ল্যাপ পাওয়া যেতে পারে, নাটকও হাউসফুল হবে। কিন্তু অভিনয় ব্যতীত বাকি ক্ষেত্রগুলো অবহেলিত হয়ে থাকবে। কোনও উন্নতির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হবে না। সেটা নাটকের ভবিষ্যতের জন্যে কখনওই মঙ্গলজনক নয়।

নাটক তো তাঁর শিরায় শিরায়। নাটক-অন্ত প্রাণ এই মানুষটি চলচ্চিত্রের আঙিনায় প্রবেশ করেন ১৯৫০ সালে পরিচালক মধু বসু পরিচালিত ‘মাইকেল মধুসূদন’ ছবিতে মাইকেলের ভূমিকায়। এরপর দীর্ঘ কয়েক দশক তাঁর অভিনয় দক্ষতা দিয়ে মাতিয়ে রেখেছিলেন টলিউড থেকে বলিউডের দর্শককে। ভিলেন থেকে কমেডিয়ান সবেতেই সাবলীল ছিলেন তিনি। তবে সিনেমার দর্শক উৎপল দত্তকে মনে রাখবেন তাঁর বিখ্যাত ডবল টেক অভিনয়ের জন্য।

সিনেমা, নাটক ছাড়াও বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের পাশাপাশি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত, পেন্টিংস, ইতিহাস, দর্শন, এবং আরবি, রাশিয়ান, জার্মান, ফরাসি ইত্যাদি বিদেশি ভাষায় সর্বত্র তাঁর সহজ বিচরণ ছিল। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অকল্পনীয়।

‘প্রতিবিপ্লব’, ‘জপেনদা’, ‘গিরিশমানস’ ইত্যাদি বাংলায় লেখা উৎপল দত্তের বেশকিছু তথ্যসমৃদ্ধ প্রাঞ্জল ভাষায় বিশ্লেষিত প্রবন্ধ বিদগ্ধ মানুষজনের কাছে বিশেষভাবে আদরনীয়। তিনি ‘রফিকুল ইসলাম’ ছদ্মনামেও বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর লেখা ‘চায়ের ধোঁয়া’ নামে একটি প্রবন্ধ সংকলনকে তো নাটকের বাইবেল হিসেবে গণ্য করা হয়।

ইংরেজদের প্রত্যক্ষ মদতপুষ্ট পরিবারের সদস্য হিসেবে পুরোপুরি পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা কোট-প্যান্ট পরা, চুরুট খাওয়া একজন ইঙ্গবঙ্গ যুবক কালের নিরিখে এবং সময়ের তাগিদে কী করে একজন খৈনিখোর পূর্ণাঙ্গ বাঙালি নাট্যকারে পরিণত হল, সেই প্রেক্ষিতে এক ঐতিহাসিক লিখেছেন- ‘স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সবচেয়ে নজরকাড়া ঘটনা হল উৎপল দত্তের চমকপ্রদ গোত্রান্তর। এককথায় ইঙ্গবঙ্গ পারিবারিক ও শ্রেণী পটভূমি থেকে বিচ্যুত হয়ে উৎপল দত্ত হয়ে উঠেছিলেন এক কালান্তরের পথিক। এক উজ্জ্বল রেনেসাঁ।’

Subscribe to our Whatsapp Group for daily news alerts.


You might also like

- sponsored -

Comments are closed.