Bengal Fast
বিশ্ব মাঝে বাংলা খবর

ওরা যায়, তবে ফেরে না!

তথাগত চ্যাটার্জি

ওদের কারও নাম হরিপদ মণ্ডল। কেউ সুশান্ত মণ্ডল। কারও নাম ছিল গোষ্ঠ নাইয়া। কারও নাম ছিল উদয় মণ্ডল। ওরা সবাই পেটের দায়ে বনে ঢুকেছিল মাছ, কাঁকড়া ধরতে। ওরা গিয়েছিল সবাই কিন্তু ফেরেনি কেউই। পরিসংখ্যান বলছে চলতি বছরে তিন মাসে সুন্দরবনের বাঘের আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে বারোজনের। একবার ভেবে দেখুন সংখ্যাটা বারো!

 

সুন্দরবনের জঙ্গলঘেঁষা মানুষগুলোর কাছে বাঘের আতঙ্ক নতুন নয়। মাতলা, বিদ্যাধরী, গোসাবার বুকে মীন ধরতে গিয়ে বাঘে টেনে নিয়ে যাওয়া কিংবা বনবিবিতে নিয়ে যাওয়া মানুষটার আধখাওয়া শরীরের খানিকটা পড়ে থাকতে দেখা– এসবই দেখে দেখে অভ্যস্ত গেঁয়ো মানুষগুলো। কোনও পরিবারের একমাত্র রোজগেরে লোকটাকেই টেনে নিয়ে গেছে দক্ষিণরায়। আশায় বুক বেঁধে সেই ঘর থেকেই গভীর অরণ্যে মধু, মোম আনতে সঙ্গীদের সঙ্গে ডিঙিতে ভেসে পড়া। সাতদিন বা মাসের শেষে যেটুকু জোটে তাতেই ঘরের বাকি মানুষগুলোর পেট চলে যায়। খাঁড়িতে কাঁকড়া ধরার সময় চোখের পলকে অন্য সঙ্গীকে টেনে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে বাঘ এমন অভিজ্ঞতাও হয় অনেকের। জঙ্গলে ঢোকার বৈধ পাসের অভাবে সামান্য ক্ষতিপূরণটুকুও জোটে না অভাবে তাড়নায় ধুঁকতে থাকা মানুষগুলোর। সুন্দরবনের দিন আনা দিন খাওয়া লোকগুলো জানেন কেমন করে বাঘের সঙ্গে ঘর করে বেঁচে থাকতে হয়। নিত্যদিন বাঘের আতঙ্ক তাড়া করে বেড়ায় ওদের।

 

- Sponsored -

লকডাউনে শুকনো মুখে ঘরে ফিরতে হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের। করোনার মারণ কামড়ে কারও বা গিয়েছে কাজ। কেউ আবার কাজে ফিরে যাওয়ার আশায় দিন গুনছেন। লকডাউন আর করোনার ইঁদুরকলে পড়ে ঘরে টাকার অভাব বাঘের চেয়েও এখন বড়। বউ, কচি ছেলেমেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে নিরুপায় হয়েই জেলে মউলিদের দলে ভিড়ে পাড়ি দিতে হচ্ছে বাঘের ডেরায়। সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে প্রাণ যাওয়া নতুন ঘটনা নয়। তিন মাসে কেন বাড়ল সংখ্যাটা। পেটের টানে জীবন বাজি রেখে জঙ্গলে ঢুকতে হচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিকদের। এখানেই ঘটছে বিপদ। মাছ, কাঁকড়া ধরার অভিজ্ঞতা না থাকায় সহজেই বাঘের মুখে পড়ে যেতে হচ্ছে গোষ্ঠ, সুশীল, সুশান্তদের। দৈবাৎ যদিবা কেউ ফিরে আসছেন শরীরে থাকছে গভীর ক্ষত। যে ক্ষত হাজার পথ্যতেও শুকোয় না! বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন। যেমনটা বয়ে বেড়াচ্ছেন বিষ্ণুপদ মণ্ডল। তবে বিষ্ণুপদর মতো বাঘের হাত থেকে বেঁচে ফিরতে পারার সংখ্যটা হাতেগোনা। করোনামুক্ত পরিবেশ আদৌ কবে পাওয়া যাবে সঠিক বলতে পারছেন না কেউই। সংক্রমণ ঠেকাতে মাসের পর মাস বন্ধ রেল পরিষেবা। শিয়ালদা ক্যানিং লোকালের কামরায় কামরায় খাবার, খেলনা ফেরি করে দু-বেলা পেটটা চালিয়ে নিতেন অনেকেই। তবুও জঙ্গলে পা নৈব নৈব চ। ওখানে গেলে বড়ে মিঞা টেনে নেবে যে!

 

আয়লার ক্ষত এখনও দগদগে সবুজ ম্যানগ্রোভে। চাষের ক্ষেত, ধানজমি চিরকালের মতো ধংব্বস হয়ে গেছে অনেকের। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে নেমে এসেছে আমফান। ভেঙে পড়া সংসারের চাকাটা ঘোরাতে বাদাবনের চাক ভেঙে মধু-মোম আনতে যেতে হয় মৈপীঠ, দেউলবাড়ি, গোপালগঞ্জ, কুমিরমারি, দয়াপুরের মতো প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষকে। সোঁদরবনের জঙ্গলে মাছ-কাঁকড়া ধরার চেয়ে ভিনরাজ্যে খেটে খাওয়া অনেক ভালো। সদ্য আঠারোয় পা দেওয়া ছেলেটাকে বুকে পাথর চেপেই তাই দূর রাজ্যে পাঠিয়ে দেন স্বামীহারা মা। মনে চেপে ধরে ভয়। যে ভয় রাতবিরেতে তাড়া করে বেড়ানোর ভয়। যে ভয় জলজ্যান্ত স্বামীকে হারানোর ভয়। করোনা পরবর্তীকালে ছন্দে ফেরায় আশায় বুক বাঁধছেন প্রান্তিক মানুষগুলো। অজানা ভাইরাসের দাপটে এক ধাক্কায় ওলটপালট হয় গেছে রোজনামচা।

করোনা লকডাউনের প্রতিকূলতাকে সঙ্গী করেই খাঁড়িতে ভেসে পড়া। গহীন গাঙে কাঁকড়া, মধু, মোম নিয়ে আসা সোঁদরবনের রয়্যাল বেঙ্গলের খাসতালুক থেকে। বিপদের ভয়কে মন থেকে দূরে ঠেলে চলতে থাকে দু-মুঠো রোজগার। দিনের শেষে নাও বেয়ে মানুষটার ফেরার আশায় চিন্তার মেঘ জমে দাওয়ায় বসে থাকা অপর প্রান্তের মানুষগুলোর কপালে। ওরা যায় দলবেঁধে। আবার ওদের মধ্যেই কেউ ফেরে না! দিনের আলো মিলিয়ে এলে ধূসর মাতলার ওপারে মিশকালো অন্ধকার থেকে ভেসে আসে বনবিবির চাপা ডাক। সে ডাক জানান দিয়ে বলে যায়, এ জঙ্গল আমার। এখানে আসা যায়, তবে ফেরা যায় না!

ছবি ঋণ : ইন্টারনেট

Subscribe to our Whatsapp Group for daily news alerts.


You might also like

- sponsored -

Comments are closed.