Bengal Fast
বিশ্ব মাঝে বাংলা খবর

মুখোশশ্রী

সৌরভ সেন

ট্যাক্সি ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে। রঙচঙে এক ভিখিরি কৌটো নাড়তেই নমস্কার ঠুকলাম। দমে না-গিয়ে সে বলল— একটা টাকাও দেবেন না? খেঁকিয়ে উঠলাম— আগে মাস্ক্-টা লাগাও, তারপর কথা বলো! ট্যাক্সিওলা-ও একই সুরে ধমকাল। তাড়াতাড়ি সে নেমে-যাওয়া মাস্ক্-টায় মুখ ঢাকতেই টং করে আমার দেওয়া ভিক্ষেটাও তার কৌটোয় পড়ল।

আমার এক দাদা পড়াতে বসে তার ছেলেকে মনে করিয়ে দিত— যা দিন আসছে ট্রেনে ভিক্ষে করতে গেলেও প্যাসেঞ্জার জিজ্ঞেস করবে গ্র্যাজুয়েট কিনা।

ভিক্ষে ব্যাপারটা শর্তহীন— এমন ধারণা টাল খেয়ে যায়। ভিক্ষে দেওয়াটা মন উজাড় করে, অথবা মন কুঁচকে— দু’ রকমেরই। নমস্কার ঠুকে শুকনো বিদায় জানানোর প্রথাও প্রচল।

তিরিশ বছর পার হয়ে যাওয়া একটা  গল্প বলি। তখন দুই বন্ধুতে গোটা রাজস্থান ঘুরে বেড়াচ্ছি মাসখানেক ধরে। ট্রেনে দুজন গায়ক লোকগীতি, ইবাদতি গান গাইছে, তালবাদ্য-সহ। চমৎকার। লোকে এক-দু’ টাকা করে দিচ্ছে। তখনকার মুদ্রামানে এটা চলনসই। একে অবিশ্যি ঠিক ভিক্ষে বলা যায় না,  শিল্পীর সাম্মানিক বলাই উচিত। তো, ওদের গলায় মানাবে ভেবেই অনুরোধ করেছিলাম “ববি” ছবির সেই “বেশক মন্দির মসজিদ তোড়ো…”— নরেন্দ্র চঞ্চলের গাওয়া, কাওয়ালি ধাঁচের গানটি। দারুণ জমে গেল। অন্যান্য গানের মতোই দক্ষিণা দিতে গেছি— গায়কের সটান স্পষ্ট নির্ঘোষ : “ফরমায়েশি গানা পাঁচ রুপয়ে।” দিলাম, এবং বুঝে গেলাম যে এটি শর্তাধীন; আগের মতো শর্তহীন নয়।

রোজকার চালচলনের কোনও কিছুই বোধহয় আর আমাদের সত্তাধীন নয়, পুরোটাই শর্তাধীন হয়ে পড়েছে। সংক্রমণের ভয়ে আমরা কবচ-কুণ্ডল ধারণ করেছি! উঠতে-বসতে, আসতে-যেতে নানা শর্ত, নানা বেড়াজাল। আমাদের মুখ জালতি-তে ঢাকা, হাতে রবারের দস্তানা, মাথা ঢাকা আচ্ছাদনে। সংক্রমিত হবার ভয় এতটাই! অর্থাৎ আপনার সঙ্গে আমার নৈকট্য যা-ই হোক না কেন, নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতেই হবে! সে তিন ফিট বা ছ’ ফিট, যা-ই হোক না কেন। আবার যাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাই, সে-ও কীনা একই দূরত্বে! ডায়াফ্রাম-ভেদী কথা চালাব, তবে কীনা শর্ত মেনে! আগে দেখব, উদ্দেশিত ব্যক্তিটি থেকে ড্রপলেট আসতে পারে কিনা, দূরবর্তিতা ” সামাজিক” হয়েছে কিনা, ইত্যাদি-ইত্যাদি। তবেই গলাগলি। অ্যাই যাঃ। গলাগলি, মাখামাখি এ-সব শব্দরাজির সঙ্গে  তো আমাদের আপাতত বিচ্ছেদ! “সামাজিক” হলে দূরত্ব-ই বা বজায় রাখব কেন? দূরত্বটা বরঞ্চ “শারীরিক” হলে ঠিক ছিল, মানে “ফিজিক্যাল”। সামাজিকতায় তো দূরত্ব ঘোচার কথা!

মুখোশ আমাদের সক্কলেরই আছে। সেটি দৃশ্যমান হয়েছে মাত্র। কিনতেও হচ্ছে।  মুখ-জালতি’তে বিজ্ঞাপন ছাপাও শুরু হয়েছে। কোম্পানিগুলো উদ্গ্রীব এ-হেন জালতি বাজারে আনতে। মুখ এবার সত্যিই বিজ্ঞাপনে ঢাকতে চলেছে। ঠোঁট, মুখের সঞ্চালনে যে-উত্তর দেওয়া যায় সে-র’ম একটি ডেলিভারি দিতে, উদ্দেশিত দেখি হাঁ-করে আমার জালতির দিকে তাকিয়ে আছে। সম্বিৎ ফিরল, বুঝলাম ঢাকা-মুখের সেই বার্তা তার কাছে পৌঁছয়নি। অগত্যা বাঙ্ময় হয়ে উত্তরটা ফের দিতে হল।

অর্থাৎ যুগ-যুগ ধরে পরস্পরিক আদানপ্রদানে গড়ে-ওঠা মুখভঙ্গিমা, ঠোঁটকুঞ্চন, আলতো হাসি সব অবশেষে মিথ্যে, অন্তত বাড়ির বাইরে। সুবিধেও কম নয়। অফিসে হাই তুললে বস্ বুঝতে পারবে না। এজলাসে বিচারপতিকে ভেঙচি কাটলেও “কনটেম্পট্ অব কোর্ট”-এর ভয় নেই। কর্পোরেট অফিসে শুনেছি হাসির প্রকারভেদে নম্বর কম-বেশি হয়। রিসেপশনিস্টদের মায়বী হাসির পাঠ নিতে হয়। সে-সব আপাতত অস্তাচলে।

- Sponsored -

যা সরাসরি দেখছি তা-ই সত্যি নয়। আবার অবগুণ্ঠিত মুখও আংশিক সত্য। তাহলে! সত্য কোথায়? আসলে, “সত্য মারা গেছে” (একদা গ্রুপ থিয়েটারের একটি নাটক)। আচ্ছা, জালতি-নিঃসৃত ভাষা কি পরিস্রুত ভাষা? কলেজবেলায় এক নিয়মিত বৈকালিক আড্ডায় যেখানে বসতাম সেখান থেকে বড়রাস্তার ওপারে একটি দোকানের সাইনবোর্ডটি আমাদের যথেষ্ট এনার্জি যোগাত। দোকানটি নাম ছিল “বিকিকিনি”। সাইনবোর্ড ছিল ইংরেজিতে। কিন্তু মধ্যিখানে একটি লাইটপোস্ট এসে দু’টি অক্ষর (KI) খেয়ে নিত। আমরা দেখতাম “BIKINI”।

আমাদের অভিযোজন ঘটবে। চোখের অভিব্যক্তিতে নতুন ভাষা আসবে। হয়তো চোখের এক অফিসিয়াল ভাষা তৈরি হবে দপ্তরের জন্যে।  কপোল ও কপালের দৃশ্যমান অংশ চোখকে সঙ্গ দেবে। হয়তো কান নাড়ানোও আমরা রপ্ত করব। “চোখ মারা” ব্যাপারটা ক্রমশ নির্দোষ আইটেম হয়ে-উঠতে চলেছে। রূপটানের কেন্দ্রে চলে আসবে চোখ? মায়া-অঞ্জন কি নিজের অধিকার আরও পোক্ত করবে? সৌন্দর্যের নতুন সংজ্ঞা তৈরি হবে? এরই মধ্যে মহিলাদের একাংশ হিজাব-গোছের মুখঢাকা এক নতুন স্টাইল-স্টেটমেন্ট দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন।

সারা শরীরের ভাষা যে শেষ পর্যন্ত চোখে আশ্রয় নেয় তার এক মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা আমার আছে। প্রিয় এক বন্ধুর বাবা মোটর নিউরোন রোগে আক্রান্ত ছিলেন। ধীরে-ধীরে সাড় কমছিল। একদিন কথাও শেষ। রইল শুধু চোখের উত্তর। একবার পলক ফেলা মানে “হ্যাঁ”, আর দু’বারে “না”।

এমনি করেই শরীর-ভাষার বিবর্তন ঘটে থাকে, সুখে দুঃখে শোকে আনন্দে— মারী ও আরোগ্য, সবেতেই। বিবর্তন ছাপিয়ে এবার বোধহয় অভিযোজনের পালা। ল্যামার্ক-এর সেই সিদ্ধান্ত— উঁচুতে থাকা গাছের পাতার নাগাল পেতে গিয়ে জিরাফের গলা লম্বা হয়ে গেছে। মুখোশের ব্যবহারে ক্লান্ত আমাদের এখন সত্যিকারের মুখোশও অঙ্গ হয়ে গেল। বেশ ভারী এক অপারেশনের দু’দিন বাদেই বিলায়েত খাঁ সাহেবের আব্দার : বেড্-এ বসেই সকালে রেওয়াজ করবেন, অতএব সেতার হাতে চাই। আঁতকে-ওঠা খ্যাতনামা ডাক্তারবাবুদের জানিয়ে দিলেন যে সেতারটা তাঁর শরীরের একটি অরগ্যান। দুর্দম অভিলাষে শুরু হল সেই প্রভাতী রেওয়াজ।

মুখোশকে আরও আঁকড়ে ধরব? মুখের চেয়েও প্রাধান্য দেব মুখোশকে? তা-ই তো দিতে হয়! বছর-কুড়ি আগে বিজেপি-র জাতীয় স্তরের তুখোড় তাত্ত্বিক নেতা কে এন গোবিন্দাচার্য বলে বসলেন : বাজপেয়ী দলের মুখোশ! অংকে ভুল করার মাশুল দিতে হয়েছিল বইকী গণিতশাস্ত্রে পারঙ্গম এই মানুষটিকে। বাজপেয়ীর অসন্তোষে দলীয় রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে হয়েছিল তাকে। আর ফিরতে পারেননি।

মুখোশের জয়গান গাইতেই হয়।

 

সৌরভ সেন : প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক, সমাজকর্মী। দেখুন : https://thesouravsen.wordpress.com/

ছবি ঋণ : ইন্টারনেট

Subscribe to our Whatsapp Group for daily news alerts.


You might also like

- sponsored -

Comments are closed.