পুতুলনাচের অন্দরমহল

ড. শুভ জোয়ারদার
ষাটের দশকের মাঝামাঝি কলকাতার গ্রুপ থিয়েটার জগতে আমার থিয়েটার চর্চার শুরু, আর পুতুলনাচে আসা আশির দশকের গোড়ায়, ভারতবর্ষের বিখ্যাত পুতুল নাট্যব্যক্তিত্ব শ্রীসুরেশ দত্তের সাহচর্যে। ছিলাম নাটকের পাড়ায়, এসে পড়লাম পুতুলনাচের উঠোনে। এর পেছনে ছোট্ট একটা সলতে পাকানো পর্ব আছে। পাকা একটা সরকারি চাকরি থাকা সত্বেও যুগান্তরের তৎকালীন সম্পাদক শ্রদ্ধেয় অমিতাভ চৌধুরী আশি সালের শুরুতে আমাকে সাংবাদিক বানিয়ে ছাড়লেন। সেই সময় কলকাতায় আন্তর্জাতিক মানের একটা বড় নাচ আর থিয়েটারের উৎসব চলছিল সপ্তাহব্যাপী, কলামন্দিরে। হুবহু ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের মতোই সেলিব্রিটিদের ভিড়। অমিতদা আমার নাট্যচর্চার খবর রাখতেন। ফলে গোটা উৎসবটা যুগান্তরের পক্ষে কভার করার দায়িত্ব পেলাম আমি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে মঞ্চ কাঁপানো নানা বিদগ্ধের ভিড়ে অনেকের সঙ্গে পেয়ে গেলাম সুরেশ দত্তকে। তার আগে থেকেই তাঁকে আমি চিনতাম এক রবিবারের সকালে হাতিবাগানের স্টার থিয়েটারে বিখ্যাত পুতুল নাটক ‘আলাদিন’-এর শো দেখার সুবাদে। সুরেশদা হলেন বিখ্যাত রাশিয়ান পুতুলনাট্য পরিচালক সের্গেই ওবরাজেভের প্রিয় ছাত্র, ষাটের দশকের চমকে দেওয়ার মতো পুতুল নাটকের মঞ্চায়ন শিখে এসেছেন রাশিয়া থেকে। মস্কো থেকে পুতুলনাটকে পাঠ নিয়ে কলকাতায় ফিরেই উনি প্রতিষ্ঠা করলেন নিজের কর্মক্ষেত্র ‘ক্যালকাটা পাপেট থিয়েটার’ ১৯৭৫ সালে। যার প্রথম প্রযোজনা ‘আলাদিন’ মঞ্চস্থ হওয়া মাত্রই গোটা কলকাতার দর্শক পুতুলনাটকের বর্ণময় আভিজাত্য আর সিনেমাটিক
মঞ্চমায়ায় মুগ্ধ হয়ে গেল।
পুতুল নাটক নিয়ে আমার যাপনপর্বটি কমবেশি ৩৫ বছরের মতো। এর অন্দরমহলে অবস্থানের সুবাদে আমার ভাঁড়ারঘরে জমা হয়েছে বেশকিছু মন্ত্রগুপ্তি আর বিচিত্র তথ্যের মণিমাণিক্য; যা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করা যেতে পারে। নাটকের চেয়ে পুতুল নাট্যকলা বরাবরই অধিক আকর্ষণীয়, সেটা তার সহজাত আড়াল বা অবগুণ্ঠনের কারণেই। অনেকে মনে করেন এটি নাটক আর ভোজবাজির মধ্যবর্তী এক শৈল্পিক সেতু। ইতিহাসের আশ্রয়ে বলা যায় বঙ্গদেশের পুতুলচর্চা কমবেশি পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন, গ্রামীণ দ্রাবিড় সভ্যতার ফসল। আদি পর্বের পুতুলবাজি, পুতুল নাচ, পুতুল পালাগান, পুতুল নাটক থেকে অত্যাধুনিক যুগের থ্রি-ডি পাপেট অ্যানিমেশন অবধি পুতুলদের এই দীর্ঘ যাত্রাপথটি সবদেশে সর্বকালে সততই জন-মনোরঞ্জক আর কমিউনিকেশনের নিরিখে একটি সক্রিয় আর শক্তিশালী মাধ্যম। মানে যুগে যুগে পুতুল নাচ তার আঙ্গিক বা ফর্ম বদল করলেও, তাকে ঘিরে আপামর জনমানসের তীব্র কৌতূহলটা কিন্তু অদ্যাবধি থেকেই গেছে। যার জন্য আমারও থেকে যাওয়া, ঘরে ঘরে ঘর পেরিয়ে পুতুলনাটকের অন্দরমহলে ঢুকে কখনও নিজেকে এই মায়াবী লোকশিল্পের সঙ্গে মানানসই করে নেওয়া, কখনওবা ব্যক্তিগত শিল্প-অভিজ্ঞতায় প্রথাগত প্রয়োগকর্মটিতে আরও একটু সহজিয়া মাত্রা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা।
কেমন করে এই কুণ্ঠিত বা অবগুণ্ঠিত শিল্পের কপাট-বাতায়ন আমার সামনে একটু একটু করে উন্মোচিত হল সেকথায় এবার আসি। আমার এতদিনের নাট্য-অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সুরেশদা আমাকে প্রথমে পুতুল নাটকের উপযোগী পাণ্ডুলিপি নির্মাণ আর সেই নাটকের গান লেখা, সুর করার দায়িত্ব দিলেন। নাটক ও সংগীত রচনার পরে সংলাপ ও গান পেশাদারি স্টুডিওতে রেকর্ডিং করে একটা কমপ্লিট অডিও ট্র্যাক করে নেওয়া হল। এখানে একটা কথা পরিষ্কার করা জরুরি। নৃত্যনাট্যে যেমন গান-সংলাপ অনুসরণে মঞ্চের শিল্পীরা আড়াল থেকে লাইভ অডিও শিল্পীদের সংলাপ-আবহ-সংগীতের সমান্তরাল শরীরাভিনয় করেন, পুতুলনাটকের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমন প্রিরেকর্ডেট ট্রাকটিকে হুবহু অনুগমন করেন হাতে পুতুল ধরা শিল্পীরা। রেকর্ডিংয়ের অডিও আর আড়ালে থাকা পুতুলধৃত শিল্পীদের নাচে কিংবা শরীর মুদ্রায় পুতুলেরা তালমেল রেখে নাচে গানে অভিনয় করে, মঞ্চ মাতায়, গোটা নাটকটি অডিও-ভিস্যুয়াল করে তোলে। এই মেলবন্ধনটি একইসঙ্গে বৈজ্ঞানিক, জরুরি এবং দীর্ঘদিন অনুশীলন সাপেক্ষ। নাটকে আমরা যাকে ‘আহার্য’ বলি, ঠিক তেমনই এর সঙ্গে যুক্ত হয় পেশাদারী মঞ্চের মতো ত্রিমাত্রিক মঞ্চসজ্জা আর নাটকের দৃশ্যানুগ মায়াবী আলো। পুতুল নাটকের যে ব্যাপারটা আলাদা নাটকের থেকে, সেটা হল– চরিত্রানুগ পুতুল নির্মাণ আর সাউন্ডট্র্যাক অনুগামী পুতুল সঞ্চালনা। আমি তো ট্রাক বানিয়ে খালাস আর ওদিকে আমারই কল্পনায় তৈরি মানসপুত্র চরিত্রগুলো নানা উপকরণে আমার সামনেই একটু একটু রূপ পাচ্ছে। নাচে-গানে-সংলাপে জীবন্ত হয়ে উঠছে। সে এক অদ্ভুত উত্তেজনার মুহূর্ত!
নেই নেই করে সাড়ে তিন দশক পার করলাম আমি পুতুলদের সঙ্গে ঘর সংসার করে। যারা মানুষের মধ্যে ঘর সংসার করেন, সেই শিক্ষিত-সাধারণ মানুষ নির্বিশেষে আমজনতার অনেকেই পুতুলের মধ্যে নিহিত কিছু অমোঘ শক্তি বা ক্ষমতার কথা জানেন না, মানে আধুনিক পুতুলচর্চার উপযোগিতা সম্পর্কে সম্যক সচেতন নন। আমি মনে করি এই জ্ঞাপনটি অনিবার্য। কী সেটা? সাধারণ মানুষের কাছে পুতুল নাটক নিছক আর পাঁচটা সাধারণ বিনোদনের উপকরণ মাত্র। বস্তুত বিষয়টি মোটেই তা নয়। তুলে ধরার মতো জরুরি তথ্যগুলি অতঃপর পরপর বলি। ভারতবর্ষ তথা প্রাক্ আর্য বাংলাদেশের গঙ্গারিড বা রাঢ়ভূমিই হল গোটা পৃথিবীর পুতুলনাট্য কলার মাতৃভূমি। মহেঞ্জোদারো যুগে বঙ্গদেশের তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে পালতোলা জাহাজে তামা, রেশম, মশলা আর সুগন্ধি দ্রব্যর সঙ্গে পুতুলনাচ প্রথমে মিশর হয়েছে গ্রিসে পৌঁছায়। পুতুল নাচ একইসঙ্গে জনমনোরঞ্জক ও প্রচারকর্মে শ্রেষ্ঠতম উপকরণ বলে হাজার হাজার বছর ধরে বিদেশে খ্রিস্টধর্ম এবং এদেশে সম্রাট অশোক, বৌদ্ধধর্ম এবং মধ্যযুগে চৈতন্যদের বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের কাজে পুতুল নাটককে ব্যবহার করে সাফল্য পেয়েছেন। এই উপমহাদেশ থেকে ইউরোপ পুতুল নাচে দীক্ষিত হয়ে আজ আধুনিক পুতুলকে ব্যবহার করছেন সমাজের নানা উন্নয়নমূলক কাজে। জনসচেতনতা, বিজ্ঞাপন, বিপণন, চিকিৎসা এমনকী মহাকাশবিজ্ঞানেও পুতুলের গ্রহণযোগ্যতা সমাদৃত। মানে, উন্নত মানের পুতুল নিয়ে ওই দেশগুলিতে সামাজিক কল্যাণ করা হয়েছে। দুঃখজনক ব্যাপার হল, পুতুলের মধ্যেকার এই গুণাবলীকে ইউরোপ যতটা কাজে লাগিয়েছে, ভারতে তার ছবিটা বিলকুল বিপরীত। এদেশে সরকারি ঘোষণাপত্রে পুতুল নাচ একটা বাতিল, মুমূর্ষু, গ্রাম্য বিনোদন মাত্র। পরম্পরার পুতুল শিল্প আর শিল্পীদের অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে শিল্পীরা বাধ্য হয়ে অন্য পেশা ধরে নিচ্ছেন। ‘বঙ্গপুতুল’ গোষ্ঠীর করা এক সমীক্ষা-অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে গত তিরিশ বছরে গ্রাম্য পুতুলনাচের দলগুলি শতকরা আটানব্বই শতাংশই লোপ পেয়েছে। যারা টিকে আছে তারা হয়, নিজেদের একটু আধুনিক করে নিয়েছে, নতুবা সেই দলগুলি পরম্পরার সনাতন গোষ্ঠী নয়, একেবারেই সমকালীন। সবচেয়ে বড় কথা হল, মৃতপ্রায় এই শিল্প বা শিল্পীদের সংরক্ষণের জন্য নয়, মানব-সভ্যতার উন্নীতকরণের স্বার্থেই যে পুতুলনাটককে ব্যবহার করা অনিবার্য– এই ধ্রুব সত্যটিই এদেশে এখনও অধরা। শুধু বিনোদনের কারণে নয়, শিল্পটি যে রুটি-রুজির ক্ষেত্রেও কর্মহীন তরুণ-তরুণীদের অর্থনৈতিক দিশারী হতে পারে, এই জরুরি তথ্য কেউ আমাদের অদ্যাবধি অনুভবে অনুপস্থিত।
সব মিলিয়ে আর দুটি কথা আমি বলব। এক, ভারতবর্ষ তথা বঙ্গদেশ যখন সারা পৃথিবীর পুতুলনাট্যকলার আঁতুড়ঘর, তখন সেই পুতুলশিল্পকে ব্যবহার করে আমরা আগামী প্রজন্মকে রুটিরুজির দিশা দেখাচ্ছি না কেন? পুতুল নাচ আজও সমান আকর্ষণীয় হওয়া সত্বেও, এরমধ্যে যাবতীয় সম্ভাবনা নিহিত থাকা সত্বেও কেন এই মহতী শিল্প বাতিল বা মৃতপ্রায় তকমা পেল! কিছু কিছু দল আছেন যারা শুধু নিজেরাই শো করেন সুনাম আর উপার্জনের লক্ষ্যে। কিন্তু শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বে যে কাজগুলি করা দরকার, সেই বিষয়ে উৎসাহ কম। একটা সারসত্য হল, পুতুলকে আমরা যতটা জড় বা প্রাণহীন বলে মনে করি, পুতুল বস্তুত কিন্তু তা নয়। সে নিজেকে, মানুষকে এমনকী মানব সভ্যতাকেও বদলে দেওয়ার শক্তি রাখে।অবিশ্বাস্য হলেও একথা সত্য। গোটা পৃথিবী তার সাক্ষী। বিশ্বাস না হলে অন্তর্জালে দেখুন এবং শুনুন।
ড. শুভ জোয়ারদার, রূপকার : ‘বঙ্গপুতুল’, যোগাযোগ : + ৯১ ৯৮৭৫৬ ১৭১৭৫
Comments are closed.