Bengal Fast
বিশ্ব মাঝে বাংলা খবর

কোভিডের বিরুদ্ধে জৈবপ্রযুক্তির লড়াই  

. স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী

মানব সভ্যতায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে জৈবপ্রযুক্তির প্রভাব অনস্বীকার্য। পূর্ববর্তী যক্ষ্মা, কলেরা, বসন্ত, ম‍্যালেরিয়া, প্লেগও মানুষের মধ্যে ঠিক একই ভাবে সংক্রমণ ছড়িয়ে ছিল। জৈবপ্রযুক্তিবিদ‍্যায় প্রশিক্ষিত মলিকিউলার বায়োলজিস্টদের আপ্রাণ চেষ্টায় কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের এত দ্রুত এই মুহূর্তে ভ্যাকসিন প্রস্তুতি সম্ভবপর হচ্ছে। বিজ্ঞানের ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে সেই সব অখ্যাত বায়ো-টেকনোলজিস্টদের নাম যারা দিনরাত্রি এক করে ‘কোভিড’ নামক ভয়ঙ্কর ভাইরাসের সাথে লড়াই করেছে। এই মারণ ভাইরাসের বিরুদ্ধে বায়োসেফটি ল‍্যাবরেটরিতে চলছে আপ্রাণ লড়াই। অত‍্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে সেখানে। আপাতত আমরা সবাই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মুক্তির আশায় দিন গুনছি। গবেষণায় প্রত‍্যেক ধাপে থাকছে নতুন চ‍্যালেঞ্জ।

এই কোভিড-১৯ রোগটি যে নিঃসন্দেহে বিশ্বের নানা দেশের স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে এক বিশাল প্রভাব ফেলেছে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে এই চরম পরিস্থিতিকে বিচার করলে দেখা যাবে এই অতিমারীর কারণে বিজ্ঞানসমাজে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে। বলা যেতে পারে, পরিস্থিতি কিছু নতুন ধরনের বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম করার সুযোগ করে দিয়েছে। সেটা বিশেষ করে বায়োটেকনোলজির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

এই রোগের সংক্রমণ হারকে কমানোর জন্য স্বাস্থ্য অধিকর্তারা ও বিভিন্ন সংস্থা যেমন সামাজিক দূরত্বের ওপর জোর দিয়েছে, তেমনই যে সমস্ত সুরক্ষাবিধি সংক্রান্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলোকে আরও গতি দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রই এখন আটকে পড়েছে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। যদিও ভ্যাকসিনের কাজে গতি আনা ও ওষুধ আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে এই অতিমারীকে আয়ত্তে আনার জন্য বায়োটেকনোলজির কিছু গবেষণা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিচ্ছে। তবে সারা বিশ্বে বেশিরভাগ অ্যাকাডেমিক গবেষণামূলক গোষ্ঠী এই পরিস্থিতিতে হয় তাদের কাজ বন্ধ রেখেছে, নয়তো কাজের ধরনটাই পাল্টে ফেলেছে।

অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে আমাদের রোজকার রুটিনে অনেক কাজ একসঙ্গে করতে হয়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আজকের পরিস্থিতিতে শিক্ষাব্যবস্থায় একটা বড় পরিবর্তন এসেছে। সংক্রমণ ঠেকাতে ক্লাসরুমের জায়গায় অনলাইন ডিস্টেন্স লার্নিংয়ের মাধ্যমে পড়ুয়াদের পড়ালেখা চলছে। কমিটির কোনও বৈঠক করতে গেলে ওয়েব কনফারেন্স বা ভিডিয়ো কনফারেন্সের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। অবশ্য এই ধরনের কিছু বদল গবেষণামূলক কাজকর্মের ক্ষেত্রে বেশ সুবিধা করে দিয়েছে। গবেষণামূলক কাজকর্ম নিয়ে যারা ভীষণভাবে উৎসাহী তাঁদের কাছে এটা একটা বড় সুযোগ। তারা এই সময়কে কাজে লাগিয়ে ফেলে-রাখা গবেষণামূলক কাগজপত্র তৈরি করে নিতে পারেন, তথ্য যাচাই, বিশ্লেষণ, এমনকী নতুন নতুন ভাবনা নিয়েও কিছু উদ্ভাবন করতে পারেন।

এছাড়া ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করা, অ্যান্টিবডি নিয়ে তথ্য বিশ্লেষণ, বিপাকীয় পদ্ধতি এসবকিছু নিয়েই এই সময়কে কাজে লাগিয়ে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলে হয়তো এখন গোটা মানবজাতি যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে আছে তার থেকে পরিত্রাণের কোনও একটা পথ বেরিয়ে আসতে পারে। তবে এটাও ঠিক এই পরিস্থিতি যে শুধুমাত্র কিছু সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ সামনে এনেছে এমনটা নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে কিছু সমস্যা আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যেমন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে একটা ল্যাবরেটরিতে একই সময়ে বেশি সংখ্যায় গবেষণার লোক উপস্থিত থাকতে পারছেন না। যারা ল্যাবরেটরিতে টেকনিক্যাল কিছু ব্যাপারে সাহায্য করে থাকেন তাঁরাও সব সময় হাজির থাকতে পারছেন না। বিশেষ করে একজন প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর ল্যাবে অনেক ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। কারণ, ল্যাবে কোনও গর্ভবতী মহিলা থাকলে, কোনও গবেষক বা ল্যাব টেকনিশিয়ানের বাড়িতে বাচ্চা বা বয়স্ক কিংবা ইমিউনোকম্প্রমাইজড সিস্টেম বা কো-মরবিটি ফ্যাক্টরগুলো থাকলে সেক্ষেত্রে ঝুঁকির সম্ভাবনা থেকেই যায়।

- Sponsored -

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই অতিমারী পরিস্থিতি একজন বৈজ্ঞানিককে তাঁর কর্তব্য পুনর্মূল্যায়নের ওপর জোর দিচ্ছে। যারা নিজের পরিবারের কাজের দায়িত্ব অন্যের উপর দিয়ে এতদিন নিশ্চিন্তে কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকত, এই সামাজিক দূরত্ব নীতি এবার তাদেরও বিপদে ফেলেছে। কারণ পরিবারের সেইসব কাজের দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে কর্মক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে গবেষণার কাজকর্ম পাশে সরিয়ে রেখে তাদেরকে পরিবারের জন্য সময় দিতে হচ্ছে। এইসব কারণে গবেষণাধর্মী প্রকল্পে বাধা আসছে। যার দরুণ কাজের জায়গায় চাপ তৈরি হচ্ছে। কাজেই এই নতুন গবেষণাধর্মী বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বিকল্প কোনও পরীক্ষামূলক টেকনিক্যাল প্রোটোকল সামনে নিয়ে আসা যা বায়োটেকনোলজির সম্পর্কিত প্রকল্পতে নিশ্চিত ভাবে সাফল্য এনে দেবে।

পড়াশোনার ক্ষেত্রে কিছু গবেষণামূলক গ্রুপ ও বেসরকারি কোম্পানিতে বিনামূল্যে ওয়েবিনার্স ব্যবস্থাকে সামনে আনা হচ্ছে যার মাধ্যমে নতুন নতুন তথ্য, প্রযুক্তি, পরীক্ষামূলক কিছু প্রোটোকল একে অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায়। এতে তরুণ গবেষকরা যেমন তাদের মূল্যবান মতামত প্রকাশের এক নতুন সুযোগ পাচ্ছেন, তেমনই তাঁদের দক্ষতা বিকাশের জায়গাও থাকছে। তবে এটা ভেবে নিলে ভুল হবে, আজকের এই পরিস্থিতিতে যে ধরনের কাজগুলো করা হচ্ছে তার দক্ষতা, গুণমান ও কাজের প্রতি নিষ্ঠা আগের মতো সমমাত্রায় থাকবে।

একজন প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর বা মেন্টর হিসেবে আমাদের সচেতন থাকতে হবে যে একা একা কাজ করার ক্ষেত্রে ও আরও কিছু চাপের কারণে অনেকে মানসিকভাবে ভীষণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। তাই কাজ করার পাশাপাশি একই সঙ্গে নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে হবে এবং অন্যরাও যাতে আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারে তার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। কারণ আমাদের বুঝতে হবে সাধারণ পরিস্থিতিতে যেভাবে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করা যায়, আজকের দিনে সেই একইভাবে কাজে মনোনিবেশ করা অসম্ভব।

পাশাপাশি বায়োটেকনোলজির গবেষণার ক্ষেত্রে যে সমস্ত প্রযুক্তিগত দিক রয়েছে তার সঙ্গে বুদ্ধিমত্তা, প্রয়োগ নীতি, সদিচ্ছা ও উদারতাকে কাজে লাগালে গবেষণার কাজটা সহজ হবে। সেটা একজন বিজ্ঞানী এবং সমাজের একজন মানুষ হিসেবে ও কাজে আসবে। অন্যান্য গবেষণার মতো জৈবপ্রযুক্তি অর্থ‍াৎ  বায়োটেকনলজির গবেষণায় ও সাফল্য ও ব‍্যার্থতা দুই থাকে কিন্তু কয়েকমাসে সরকারি ও বেসরকারি ল‍্যাবে ভ‍্যাক্সিন গবেষণার প্রত‍্যেকটা ধাপ সুচারু রুপে পেরোনোর জন্যে একজন জৈবপ্রযুক্তি গবেষক যে নিরলস প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তা নিঃসন্দেহে কুর্নিশযোগ্য।

ব্রিটেনের মেডিসিন হেলথ রেগুলেটরি অথরিটি অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য খতিয়ে দেখছে। ভারত বায়োটেকের কোভ‍্যাক্সিন অ্যানিম‍্যাল ট্রায়ালে সাফল্যের সাথে এগিয়ে চলছে। আসলে ভ‍্যাক্সিন তৈরির এই চূড়ান্ত পর্যায়ে চলছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রধানত চারটি দলে ভাগ করে কুড়িটি রেসাস ম্যাকাস প্রজাতির বাঁদরকে অ্যানিম‍্যাল ট্রায়ালের জন্যে বেছে নিয়ে প্রায় চোদ্দোদিন করোনা আবহে রেখে বাঁদরগুলির শরীরে দ্বিতীয় বার টিকা প্রয়োগ করে দেখছেন ভ‍্যাক্সিন প্রস্তুতকারি সংস্থাগুলি। দেখা গেছে ওই বাঁদরগুলি এখনও পর্যন্ত‍ নিউমোনিয়াতে আক্রান্তও হয়নি। এদের গলা ও ফুসফুস থেকে যেসব নমুনা সংগ্ৰহ করা হচ্ছে যেখানে জৈবপ্রযুক্তির বিভিন্ন পলিমারেজ চেন রিঅ্যাক্সন (RTPCR), এলাইসা পরীক্ষার মাধ্যমে ভ‍্যাক্সিন প্রস্তুতির কাজ দ্রুততার সাথে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। তারা দিনরাত্রি এক করে তাদের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

জৈবপ্রযুক্তিবিদরা আগামী দিনে এইধরনের কাজে যুক্ত হওয়ার সাথে সাথে বিজ্ঞানের এক অন্যতম ভূমিকা পালন করবে। আজ আমরা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও চরম কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়েছি। আগামী দিন ঠিক কী নিয়ে আসতে চলেছে তার কোনও ধারণা এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে কারওর পক্ষে করা সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে মৃত্যুর সংখ্যা ও আক্রান্তের সংখ্যা যখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তখন করোনা ভাইরাস নিত্যনতুন চ‍্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। চোয়াল শক্ত করে তা গ্ৰহণ করে নিরলস গবেষণায় ব্রতী থাকছে একদল বিজ্ঞানকর্মী। তাঁদের জন্য রইল দুটি শব্দ “চরৈবতি”, “জয়তু ভব”।

———————–

. স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী, জনস্বাস্থ্য পরিবেশ বিজ্ঞানী
ছবি ঋণ : ইন্টারনেট

 

Subscribe to our Whatsapp Group for daily news alerts.


You might also like

- sponsored -

Comments are closed.