Bengal Fast
বিশ্ব মাঝে বাংলা খবর

মৃত্যু ও রবীন্দ্রনাথ

সুদীপ চট্টোপাধ্যায়

 

‘‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে

তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে’’

১৯৪১ সালের আজকের দিনটিতে (৭ অগস্ট, ২২শে শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) ইহজগৎ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন আমাদের প্রাণের ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত তিনি অবশ্য আমাদের কাজ ছাড়া হননি একটা মুহূর্তের জন্য। তাঁর গানে-কবিতায়-গল্পে তিনি সবসময় বিরাজমান আমাদের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বসাহিত্যের এমন একজন কবি বা সাহিত্যিক জীবনদর্শনের কোনও কিছুই বাদ পড়েনি তাঁর লেখনীতে। মৃত্যু, এমন একটি অমোঘ সত্য যা থেকে এড়াতে পারে না কেউ-ই। তাই রবীন্দ্রনাথের কবিতায়-লেখায় বারবার ফুটে উঠেছে ‘মৃত্যু’ শব্দটি। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর মৃত্যুচিন্তা নিয়েই এই বিশেষ প্রতিবেদন– ‘মৃত্যু ও রবীন্দ্রনাথ’।

এক প্রখ্যাত রবীন্দ্র ভক্ত বলেছিলেন, সারাবছর কখনও মনে হয় না তিনি নেই, মনে হয় তিনি আমাদের সঙ্গেই আছেন। কিন্তু এই দিনটাতে কেন যেন শূন্যতা এসে বাসা বাঁধে প্রাণের অন্তরে। নিয়ত মনে হতে থাকে তিনি নেই ইহজগতে। আজ বাইশে শ্রাবণে সেই কথাটাই বড় বেশি মনে পড়ে।

রবীন্দ্রনাথ মরণকে বহুবার কাছ থেকে দেখেছেন। বালক বয়সে মাতৃহীন হবার পর থেকে ক্রমাগত প্রিয়জনের মৃত্যুশোক তাঁর নিজ জীবনের ওপর ছায়া ফেলেছে বারবার। অল্প বয়সে মৃত্যুবিরহ কাতর হৃদয়ের একটি আর্তনাদ, এই দুঃখস্বর প্রশ্নরূপে উত্থিত হয়েছে বারবার। কিন্তু পরিণত বয়সে বিশেষ করে বিদায়ের কয়েক বছর পূর্ব থেকে মুত্যু সম্বন্ধে বহু কবিতা রয়েছে কবির। কেবল প্রশ্ন নয়, মানুষের কিছু চির-নিরুত্তর প্রশ্নের কিছু কিছু উত্তরও তার মধ্যে ধরা পড়েছে।

রবীন্দ্রনাথ মৃত্যু-ভাবনা নিয়ে অনেক লিখেছেন। রোগে-বার্ধক্যে তিনি অপরাজিত। মানুষের ভালবাসার অকৃপণ উৎস তাঁকে এমন অপরাজেয় শক্তি যুগিয়েছে। তাই বিদায়বেলায় তিনি লিখেছেন,

‘‘এ বিশ্বেরে ভালোবাসিয়াছি।

এ ভালবাসাই সত্য এ জন্মের দান।

বিদায় নেবার কালে

এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার।’’

আবার এক কঠিন রোগ থেকে সেরে ওঠার পর একখানা চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘‘মৃত্যুর ভিতর দিয়ে ফিরে আসা সকলের ভাগ্যে ঘটে না। যদি ঘটে, তবে অন্তত তখনকার মত অহমিকা শিথিল হয়ে আসে কতখানি স্থায়ী হয় বলতে পারিনে। প্রিয়জনের মৃত্যুর পর বৈরাগ্য আসে নিজের মৃত্যুর সময় দেখি যে সব জিনিস অত্যুক্তি করেছে। মৃত্যুর ব্যথা দেখে তাকে যেন অশ্রদ্ধা না করি।’’ মৃত্যু সম্পর্কে এমনই সত্যই ফুটে উঠেছে কবির কথায়।

বিশ্বকবি রচনায় বহুবার উঠে এসেছে মৃত্যু। দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন জীবনকে আটকিয়ে রাখা যায় না বা যাবে না। তিনি লিখেছেন, ‘জীবনেরে কে রাখিতে পারে, আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে।’ তিনি অন্য জায়গায় বলেছেন, ‘অনন্তকে তো অন্তের মাঝে পেয়েছি-জীবনকে এই সীমান্তেই বন্দি করার ইচ্ছা লোলুপতা মাত্র-অপারেশন করে কি হবে-যে নিয়মে ঝরে যায় শুকনো পাতা, খসে পড়ে ফল, সেই নিয়মে স্বাভাবিকভাবে আমি ঝরে যেতে চাই।’ এ সব সত্য কবি জীবন দিয়ে বুঝেছেন। কবির জীবনের প্রতিটা পর্বে মৃত্যু চিন্তা এসেছে বিভিন্নভাবে।

প্রথম বয়সে কবির কাছে মৃত্যু ছিল কালো শ্যামের প্রতীক। তিনি লিখেছিলেন,

‘‘মরণ রে,

- Sponsored -

তুহুঁ মম শ্যাম সমান।’’

কিন্তু কবির জীবনের পরিণতির সঙ্গে সঙ্গে কালো শ্যাম আর মৃত্যুর প্রতীক নয়, শুভ্র মহাদেব মৃত্যুর প্রতীক হয়ে পড়েছেন। তাই তিনি লিখতে পারলেন-

‘‘যবে বিরহে চলিলা বিলোচন

ওগো মরণ, হে মোর মরণ,

তার কত মতো ছিল আয়োজন,

ছিল কত শত উপকরণ।’’

আবার জীবন সায়াহ্নে এসে কবির এক গভীর আকুতি পরমপুরুষের সান্নিধ্যলাভ। এই সান্নিধ্যলাভের মধ্য দিয়েই কবি পরম সুখ পেতে চান যে অনন্ত জীবন সামনে রয়েছে সে জীবনে। তাইতো তিনি গেয়েছেন-

‘‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো।

সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো।।

কর্ম যখন প্রবল-আকার গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার

হৃদয়প্রান্তে, হে জীবন নাথ, শান্ত চরণে এসো।।’’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৮০ বছরের জীবদ্দশায় চল্লিশটি মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছিলেন। মৃত্যু রবীন্দ্রনাথের জীবনে ছায়া ফেলেছিল, কিন্তু ঢেকে দিতে পারেনি আঁধারে। কারণ মৃত্যুকে তিনি অন্তরে পালন করেছেন অমৃতরূপে। মৃত্যু সেখানে জীবনের নতুন শিল্প। কাছের মানুষের মৃত্যুতে সাময়িক শোকবিহ্বল হয়েছেন। কিন্তু যখন অন্যকে সান্ত্বনা দেওয়ার ছলে নিজেও সান্ত্বনা খুঁজেছেন তখন শোককে পরিণত করেছেন শক্তিতে; এগিয়ে রেখেছেন জীবন থেকে অনেক বেশি মহৎ করে, যেখানে জীবন-মৃত্যু শিল্পে, এবং শিল্প পরিণত হয়েছে সৌন্দর্যে। কবির ভাবনায় মৃত্যু কখনও প্রণয়ী, বাউল, কখনও বা বালিকা বধূর বর বেশে, সখা সেজে বন্ধুরূপে, অন্ধকারের ধ্যাননিমগ্ন ভাষার মতো অবগুণ্ঠনের আবরণ পরে, অরুণবহ্নির রুদ্র সাজে, জীবনরথের সারথি হয়ে, ললিত লোভন মোহন রূপে কিংবা জ্যোতির্ময়ের পরশমণি হয়ে ধরা দিয়েছে।’’

মৃত্যু নিয়ে তাঁর শোক, ক্ষোভ, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, ধিক্কার, নীরবতা প্রকাশ করেছেন কখনও কবিতায়, কখনও স্মৃতিকথায় কখনও গানে, কখনও চিঠিতে, কখনও বক্তৃতা, কখনও প্রবন্ধ, কখনও বা গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে। এঁদের সবার মৃত্যুর প্রভাব কবির জীবনে একরকম ছিল না। এমনকী তাঁর লেখালিখিতে তিনি তা লুকাতে পারেননি। যেমন লুকাতে পারেননি প্রিয় বউদি কাদম্বরী দেবীর অকৃত্রিম ভালোবাসা, বেদনার্ত মৃত্যুশোক। তাই দেখা গেছে বিভিন্ন স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ, চিঠি, ভ্রমণকথা, কবিতা, গান ইত্যাদি সবকিছুর মধ্যে তাঁকে খুঁজে ফেরার আকুল-আকুতি কবির। তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ বইয়ের ‘মৃত্যুশোক’ অধ্যায়ে এক জায়গায় কবি লিখেছেন, ‘‘আমার চল্লিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় ঘটলো তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছে।’’

কোনও দার্শনিক ছাড়া মৃত্যুকে এমন নিরাসক্তভাবে বোধ হয় অবলোকন করেন না আর কেউ। যেমনটি করেছেন রবীন্দ্রনাথ। মৃত্যুশোককে আমরা সবসময় কল্পনা করি পাহাড় কিংবা সমুদ্রের সঙ্গে যা সহজে লঙ্ঘন বা অতিক্রম করা যায় না। কিন্তু মৃত্যু পৃথিবীতে এসেছে জিততে, হারতে শেখেনি সে। কিন্তু মৃত্যু নিজে জেতে না, কেউ জিতিয়ে দেয় তাকে। মৃত্যু নতুন সৃষ্টির অনুপ্রেরণা। তাহলে সে কেন হারবে? কেনই বা হারবে মানুষ মৃত্যুর কাছে। কিন্তু এও সত্য যে মানুষ হেরে যায়। যে ‘হার’টা শব্দের ফ্রেমে বাঁধা। হেরে গিয়ে জিতে যায়। কিন্তু যিনি বলেন, ‘আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা বলে, যাব আমি চলে’- তিনি তো হারতে আসেননি। কারণ তিনি মৃতুঞ্জয়ী।

 

তথ্যসহায়তা :
১) ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য, প্রবন্ধ: বাংলার লোকশ্রুতি। ২) মনসুর আহমদ, প্রবন্ধ : ‘রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু দর্শন’।
৩) রবীন্দ্রনাথ : জীবনে মৃত্যুর ছায়া; লেখক: অঞ্জন আচার্য। ৪) আনন্দ দাশগুপ্ত, প্রবন্ধ : ‘মৃত্যুর রূপ’ জীবনে, সৃষ্টিতে।

Subscribe to our Whatsapp Group for daily news alerts.


You might also like

- sponsored -

Comments are closed.