অমিতাভ বচ্চনকে ‘ফেলুদা’ চেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়
স্বাধীনতা উত্তর কালের সবচেয়ে বড় বাঙালি আইকন। তাঁর কর্মকাণ্ডের শুরুটা হয়েছিল একটা দীর্ঘ সময় ধরে, বহু সংগ্রাম করে। কিন্তু তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে তাঁর কাজের জগৎ হবে সেলুলয়েডের দুনিয়াই। তিনি বাঙালির সাত রাজার ধন এক মানিক-- সত্যজিৎ রায়। গত ২ মে একশো বছরে পা দিলেন তিনি। শতবর্ষে সত্যজিৎ স্মরণে বিশেষ নিবন্ধ।
শৌভিক মজুমদার
গত ২ মে একশো বছরে পা দিলেন স্বাধীনতা উত্তর কালের সবচেয়ে বড় বাঙালি আইকন। তাঁর কর্মকাণ্ডের শুরুটা হয়েছিল একটা দীর্ঘ সময় ধরে, বহু সংগ্রাম করে। কিন্তু তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে তাঁর কাজের জগৎ হবে সেলুলয়েডের দুনিয়াই। হতেই পারত তিনি ‘ডি. জে. কিমার’ বিজ্ঞাপন এজেন্সির মোটা মাইনের চাকরি করে বৈভব আর আয়েশকে অবলম্বন করে সফল একজন বাঙালি মধ্যবিত্ত হিসেবেই থেকে যেতেন কিংবা একজন দক্ষ আঁকিয়ে হিসেবেই পেশাদার শিল্পী পরিচয়ে পরিচিত হতে পারতেন। আঁকাকে পেশা হিসেবে কেন বেছে নেননি তার কারণ দর্শাতে গিয়ে তিনি পরে একবার বলেছিলেন যে, ছবি আঁকার দুনিয়ায় ইতিমধ্যে এত উচ্চমানের সব কাজ হয়ে গেছে তাঁর মনে হয়েছে তিনি তার সমকক্ষ হতে পারবেন না। তাই তিনি শিল্পের এমন এক মাধ্যমকে বেছে নিলেন যার তখন সম্ভাবনা ছিল অতলান্ত। ১৯৫১-র ২৭ অক্টোবর সকালে একটা চিত্রনাট্যের খাতা, একটা পুরোনো মিশেল ফিল্ম ক্যামেরা, শিশু অভিনেতা সুবীর বন্দোপাধ্যায় আর কয়েকজন উৎসাহী বন্ধুকে নিয়ে শুরু করে দিলেন নিজের স্বপ্নের সোপান পাড়ি দেওয়া। যদিও মূল ছবিতে প্রথম দিনের কাজটি রাখা যায়নি। সিনেমা বানানোর সলতে পাকানোর কাজ অবশ্য শুরু হয়েছিল কয়েক বছর আগে যখন জঁ রেনোয়া কলকাতায় এলেন ‘দ্য রিভার’ ছবিটির শুটিং করার উদ্দেশ্যে। তখন শুধুই তিনি এক ফিল্ম উৎসাহী যুবক। বা যখন সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে তিনি লন্ডন প্রবাসে রয়েছেন এবং লিন্ডসে অ্যান্ডারসন নামে এক সুহৃদের আনুকূল্যে লন্ডন ফিল্ম ক্লাবের সদস্য হয়ে দেখছেন বিখ্যাত সব সিনেমা– ভিত্তোরিও দেসিকার ‘বাইসাইকেল থিভস্’, ‘শু সাইন’, রবার্তো রসেলিনির ‘ওপেন সিটি’ বা আরও অনেক নতুন ধারার সিনেমা। কখনও দেখছেন স্যর লরেন্স অলিভিয়ের পরিচালিত নাটক ‘আ স্ট্রিট কার নেমড্ ডিজায়ার’, যেখানে মঞ্চে অভিনয় করছেন প্রবাদপ্রতিম অভিনেত্রী ভিভিয়ান লে। আজ তাঁর অনুরাগীরা সবাই জানেন যে লন্ডন থেকে জাহাজে ফেরার পথে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘আম আঁটির ভেঁপু’ গল্প থেকে চিত্রনাট্যের খসড়া করতে শুরু করেন। তিনি বাঙালির সাত রাজার ধন এক মানিক– সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray)।
‘পথের পাঁচালী’ ছবির শুটিং থেকে সরকারি অর্থানুকূল্য সবই বহুপঠিত। সে কথা গল্পচ্ছলে ছোটদের জন্য লিখে গেছেন, ‘একেই বলে শুটিং’ এবং ইংরেজিতে ‘স্পিকিং অফ ফিল্মস’। চরিত্র নির্মাণ, অভিনেতা নির্বাচন, পোশাক, লোকেশন এবং শুটিঙের সাত-সতেরো বিদ্ধৃত আছে সেখানে। তাই ধান ভানতে শিবের গীত করা থেকে বিরত থাকলাম।
চল্লিশ বছরের কর্মজীবনে ‘পথের পাঁচালী’ থেকে ‘আগন্তুক’ মোট ২৯টি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র, দুটি ছোট ছবি এবং পাঁচটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। চিত্রনাট্য ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন নিত্যানন্দ দত্ত পরিচালিত ‘বাক্স বদল’ চলচ্চিত্রের। এছাড়াও অনেক সিনেমাতে তাঁর অবদান রয়েছে প্রত্যক্ষভাবে, যেমন আইভরি-মার্চেন্টের সিনেমা ‘শেকসপিয়রওয়ালা’। এই ছবিকে সঙ্গীতবদ্ধ করেন সত্যজিৎ। কিন্তু যা তিনি করতে চেয়েছিলেন অথচ করতে পারেননি তার তালিকায় একটু চোখ রাখা যাক।
আরেক বিশ্ব নাগরিক বাঙালি সঙ্গীতস্রষ্টা পণ্ডিত রবিশঙ্করের উপর তথ্যচিত্র সেই তালিকায় পড়ে। মহাকাব্য মহাভারতের মতো একটা বিশাল প্রেক্ষাপটের কাহিনি নিয়ে তাঁর মতো করে একটা সিনেমা করার ইচ্ছে ছিল। নিঃসন্দেহে একটা ক্লাসিক হতে পারত। ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডি-নির্ভর একটি সিনেমা করতে চেয়েছিলেন অমিতাভ বচ্চনকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে কিন্তু পরে তা অজানা কারণে (ভারতবর্ষে এরকম একটা সংবেদনশীল অথচ জটিল বিষয় নিয়ে আদ্যন্ত রাজনৈতিক ছবি করা প্রায় অসম্ভব) মুলতুবি করে দেন। এমনকী আটের দশকে টিভির জন্য ‘সত্যজিৎ রায় প্রেজেন্টস’ প্রযোজনা করার সময়ে হিন্দি ভাষার ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করার জন্য ওঁর প্রথম পছন্দ ছিল অমিতাভ বচ্চন।
সেই মাণিকজোড় হলে হিন্দিতে ফেলুদাও নিঃসন্দেহে একটা মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলত। এডওয়ার্ড মর্গ্যান ফর্সটারের রচনা ‘আ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’ নিয়ে ছবি করতে চেয়েছিলেন যা কিনা ১৯৮৪ সালে করেন তাঁরই বন্ধু ডেভিড লিন। এবং অবশ্যই সেই হলিউডের ঘটনা! ১৯৬৭ সাল নাগাদ তাঁর নিজের গল্প ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ ও ইংরেজি চিত্রনাট্য নিয়ে হলিউডের কলম্বিয়া পিকচার্স প্রযোজনায় ছবি করবেন ‘দ্য এলিয়েন’, অভিনয় করবেন স্টিভ ম্যাকুইন, পিটার সেলার্স এবং মার্লন ব্র্যান্ডো। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ছবিটি প্রযোজনা করা থেকে পিছিয়ে যায় প্রযোজক। কিন্তু হলিউডে রয়ে যায় সেই না-হওয়া ছবির চিত্রনাট্য।
সত্যজিৎ রায়ের ‘দ্য এলিয়েন’-র আদলে বহু বিতর্কিত ছবি ‘ই.টি.’, যেটি পরে করেছিলেন স্টিভেন স্পিলবার্গ ১৯৮২ সালে। যদিও স্পিলবার্গ তাঁর ছবির সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্যের মিলের কথা অস্বীকার করেন। পরে খ্যাতনামা ব্রিটিশ লেখক আর্থার সি ক্লার্ক এই নিয়ে সত্যজিৎ রায়কে পরামর্শ দেন বিষয়টি নিয়ে আদালতে যাবার জন্য কিন্তু সত্যজিৎ রায় তা করেননি।
খাস কলকাতার ‘দ্য লাস্ট ইংলিশম্যান’ আরও কয়েকটি বিষয়ে ছিলেন ব্যতিক্রমী। বিথোভেন-ভক্ত সত্যজিতের রেকর্ড সংগ্রহ ঈর্ষণীয় এবং দুর্লভ। অনেক বিরল বইতে সমৃদ্ধ তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরি যে কোনও সত্যজিৎ অনুরাগীর কাছে এক অবশ্য দ্রষ্টব্য। শুধুমাত্র চলচ্চিত্র পরিচালক-চিত্রনাট্যকার হিসেবেই তিনি খ্যাতির গজদন্ত মিনারে অবস্থান করতে পারতেন কিন্তু তিনি তো উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার রায়ের উত্তরাধিকার বহন করছেন। কালি-কলম-তুলি না ধরলে কী করে হবে?
ইংরেজি দৈনিক ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র জন্য ছোট গল্প লিখেছিলেন ১৯৪১-‘৪২-এ। ‘অ্যাবস্ট্রাকশান’ এবং ‘শেডস অফ গ্রে’। ছয়ের দশকে লিখলেন ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’। সেই শুরু। তারপর ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি সঙ্গে ‘জটায়ুর কীর্তিকলাপ’, ‘প্রফেসর শঙ্কু’র কল্পবিজ্ঞান কাহিনি বাঙালি জীবনের কন্দরে প্রবেশ করে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিল। কিশোর সাহিত্যে তাঁর রচিত ছোটগল্পে হাস্যরস, ভ্রমণ, জটিল মনোজগৎ, কল্পবিজ্ঞান, পরাবাস্তব, আধিভৌতিক জগৎ নিয়ে যে সাত রঙ ধরিয়ে দেন পাঠকের মনে তা দীর্ঘস্থায়ী এবং কালজয়ী। সুধী সমালোচক অভিযোগ করেন সত্যজিৎ রায়ের রচনা নারী চরিত্র, প্রেম, যৌনতা, জীবনসংগ্রাম বর্জিত। আসলে তাঁর বাবা বা ঠাকুরদার মতো সত্যজিৎ রায়েরও পছন্দের বিষয় ছিল শিশু ও কিশোর সাহিত্য। তবু পাঠককে মনে করিয়ে দিই কিংবদন্তি ফরাসি অঁরি ফ্রেই-এর প্রযোজনায় ফরাসি টিভির জন্য প্রাপ্তমনস্কদের জন্য একটা ছবি করেছিলেন- ‘পিকু’- তাঁরই লেখা কিশোর কাহিনি থেকে। এক কিশোরের ডাইরির বয়ান। এই ছবিতে চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে বিবাহবহির্ভূত যৌনসম্পর্ক দেখানো হয়। আজ যখন শতবর্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে নেটফ্লিক্সের মতো ওটিটি ‘রে’ শীর্ষক সত্যজিৎ রায়ের গল্পনির্ভর ছবি প্রযোজনা করে তখন সেখানে সময়ের নিরিখে কাহিনি আমূল বদলে যায়। সেখানে অবৈধ প্রেম, যৌনতা, রিরংসা, প্রণয়হীনতা সব এসে পড়ে।
এক কলম লেখায় সত্যজিৎ রায়ের সুবিশাল কাজের জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া অসাধ্য। ব্যক্তিগত দিক নিয়ে একটু বড় চর্চা করার জন্য বলি অবসর সময়ে ক্রসওয়ার্ড পাজল্, রিডলস্ বা ধাঁধা এবং বিভিন্ন ধরণের ওয়ার্ড গেমস্ ছিল তাঁর পছন্দ। আর ভালোবাসতেন শিস্ দিয়ে সুর তুলতে। যেহেতু পাশ্চাত্য সঙ্গীত ছিল তাঁর একান্ত অনুরাগের বিষয়। একটা গোটা সিম্ফনি শিস্ দিয়ে শোনাতে পারতেন। নিঃসন্দেহে একটা বিরল পাসটাইম! ওঁর আরেকটা বিষয়ে আসক্তি ছিল এবং সেটা অবশ্যই ম্যাজিক! নিজে নানা রকম হাত সাফাই ও কার্ড ম্যাজিকে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ম্যাজিক যে তাঁর অনুরাগের বিষয় সেটা বোঝা যায় যখন গল্পের বিষয়বস্তু হয়ে পড়ে নির্ভেজাল ম্যাজিক। এমনকী তাঁর আত্মজীবনীতে (যখন ছোট ছিলাম) এক দক্ষ জাদুকরের জাদু দেখে মোহিত হবার কথা লেখেন। তাঁর সৃষ্ট সিনেমা-ম্যাজিকে তো মোহিত গোটা বিশ্ব। আকিরা কুরোসাওয়া থেকে অড্রে হেপবার্ন। যে কারণে কিংবদন্তি ফরাসি অভিনেতা জেরার্ দেপারদিউ কলকাতা ছুটে আসেন সত্যজিৎ রায়ের গল্পনির্ভর ছবি প্রযোজনা করার জন্য এবং জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে থাকা সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘শাখাপ্রশাখা’ প্রযোজনা করেন। এ তো সত্যিই একধরনের ম্যাজিক স্পেল!
আর সিনেমায় গুপি বাঘার ভূতের রাজার বরের (সেটা মায়া বিভ্রম অর্থাৎ স্রেফ ম্যাজিক!) কথা নাইবা লিখলাম। চরিত্রের নিখুঁত ডিটেলিং সমৃদ্ধ সত্যজিৎ রায়ের ‘খেরোর খাতা’ আজও ছবি-করিয়েদের বাইবেল। এ প্রসঙ্গে বলি অতি স্বল্প বাজেটে করা ছবি ‘সোনার কেল্লা’ ছবির আউটডোর রাজস্থানে। যাতে ছবির বাজেট হাতের বাইরে না চলে যায় তাই ছবির মতো একটা চার্ট তৈরি করেছিলেন। কবে কোথায় কখন শুটিং, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছনো, লোকেশন দেখা, বিশ্রাম ইত্যাদি লজিসটিকস নিয়ে এক শিল্পসম্মত চার্ট। নিজের চোখে সেটা দেখেছি বলেই বলছি সেটাও ওয়ার্ক অফ আর্ট। আর বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকতে আঁকতে, অনেক বছর ধরে নিজের ছবির নামাঙ্কন, পোস্টার ডিজাইন করতে করতে নিজেই একটা হরফ সৃষ্টি করে ফেললেন। ‘রে রোমান’। তিনিই একমাত্র এশিয়ান যাঁর নিজের নামে হরফ বা টাইপফেস আছে। এও ম্যাজিক বই কী!
——–
শৌভিক মজুমদার : লেখক, সাংবাদিক, সঞ্চালক ও নাট্যকর্মী
ছবি ঋণ : ইন্টারনেট
Comments are closed.