প্রয়াত জঙ্গলমহলের ‘ফরেস্ট ম্যান’ হপন মাঝি
নিজস্ব সংবাদদাতা : প্রয়াত বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লোকসংস্কৃতি গবেষক হপন মাঝি। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর। দীর্ঘদিন ধরে হৃদযন্ত্রের সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। সূত্রের খবর, বেলপাহাড়ির মুরারিতে গ্রামের বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন এই গবেষক-সাংবাদিক। পরিবারের লোকজন ঝাড়গ্রাম জেলা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার পথেই তাঁর মৃত্যু হয়।
হপন মাঝির মৃত্যুসংবাদ পেয়ে শোকবিহ্বল হয়ে পড়েন তাঁর বন্ধুবান্ধব ও গুণমুগ্ধরা। মৃত্যুর খবরে দীর্ঘদিনের বন্ধু সাংবাদিক ও লেখক অর্ক চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘হপন মাঝির সঙ্গে আমার পরিচয় আটের দশকের শুরুতে। তখন আমি বেলপাহাড়িতে সদ্য এসেছি কর্মসূত্রে। এইখানে নবরতন কর্মকার রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত এক শিল্পী ছিল। শিলদায় একটা হাট বসত। ওখানে একটি গুমটিতে পাথরের মূর্তি তৈরি করত। তার উল্টো দিকে চেম্বার ছিল হপন মাঝির। তদানীন্তন ঝাড়গ্রাম উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী ডা. শম্ভু মাণ্ডির একটি পাথরের মূর্তি তৈরি করেছিলেন। শম্ভু মাণ্ডি আবার নবরতনদার ছোটবেলার বন্ধু। তা সেই মূর্তিটা নাকি হয়েছিল অসুররূপী। সেই মূর্তি দেখে লাল ঝান্ডা বাহিনী শম্ভু মাণ্ডির নেতৃত্বে ভাঙচুর চালায় নবদার দোকানে। ভেঙে দেওয়া হয় তাঁর পাথরের কাজ। সেই সময় যে মানুষটি এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি হপন মাঝি। নিজের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে বুক চিতিয়ে লাল ঝান্ডা বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়েছিলেন তিনি। হপন মাঝি তখন মেদিনীপুরের ছোট ছোট স্থানীয় পত্রিকায় কাজ করছেন। পরবর্তী কালে ‘কাঁথি’, ‘উপকূল বার্তা’ ও ‘চেতনা’ নামে সংবাদপত্রে গ্রামবাংলার ভিতরের খবর তুলে ধরছে হপন। আমার জঙ্গলমহল চেনানোর অন্যতম বন্ধু হপন। তাঁর বিদায় আমাকে ভারাক্রান্ত করেছে। ৪০ বছরের বন্ধুত্বের আজ বিদায়।’
পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে বন্ধুবিদায়ের বার্তাও দেন অনেকে। তেমন এক বন্ধু নিখিল মাইতি লিখেছেন, ‘অকৃত্রিম বন্ধু, সাংবাদিক জঙ্গলমহলের এনসাইক্লোপিডিয়া প্রকৃতি সংরক্ষণ আন্দোলনের অগ্রণী নেতা মনোরঞ্জন মাহাতো আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গিয়েছেন এই খবর জানতে পেরে আমি শোকাহত। আমি তাঁর পরিবার ও গুণগ্রাহীদের সমবেদনা জানাই। জঙ্গলমহলের এই সুসন্তানের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।’
আটের দশকে মেদিনীপুর থেকে সাংবাদিকতা শুরু হপন মাঝির। জঙ্গলমহলের ভূমিপুত্র এই সাংবাদিকের আসল নাম মনোরঞ্জন মাহাতো। প্রকৃত নামের বাইরে ছদ্মনাম ‘হপন মাঝি’ নামেই সকলের কাছে বেশি পরিচিত ছিলেন। জঙ্গলমহলের প্রত্নতাত্ত্বিক ও লোকসংস্কৃতি নিয়ে চর্চার পাশাপাশি সাংবাদিকতাও করতেন হপনবাবু। মেদিনীপুর থেকে প্রকাশিত একাধিক দৈনিক সংবাদপত্রে কাজ করার পাশাপাশি নয়ের দশকে দৈনিক ওভারল্যান্ড পত্রিকায় ঝাড়গ্রাম ও মেদিনীপুরের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। এরপর যোগ দেন সংবাদ প্রতিদিন-এ। সাংবাদিকতা করেছেন ‘দি বেঙ্গল পোস্টে’ও।
হপন মাঝি পাস করা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ছিলেন। তাঁর ঝুলিতে ছিল ডিএমএস ডিগ্রি। জঙ্গলমহলের গরিব মানুষদের অসুস্থতার খবরে ছুটে গেছেন অহরহ। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবাও দিয়েছেন তিনি। প্রত্নতাত্ত্বিক ও লোকসংস্কৃতি এবং সাংবাদিকতা ছাড়াও জঙ্গলমহলে সবুজ বনানীর জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। এলাকার যুবকদের নিয়ে প্রচুর গাছও রোপণ করেছিলেন। সবুজের জন্য এই অভিযান তাঁকে অন্যমাত্রা দিয়েছিল জঙ্গলমহলে। সেইজন্য হপন মাঝি ‘ফরেস্ট ম্যান’ হিসেবেও বেশ পরিচিত ছিলেন।
Comments are closed.