Bengal Fast
বিশ্ব মাঝে বাংলা খবর

‘ভরপেট নাও খাই, রাজ আজ্ঞা শোনা চাই’

শোভন সেন

সময়, মেঠো ইঁদুরের মতো, সহ-নাগরিকদের ঢুকিয়ে  নিচ্ছে মৃত্যুর ঘরে। এরই মধ্যে ঢেঁকি তার ধান ভেঙে যাচ্ছে যথারীতি। হ্যাঁ, এই মৃত্যু উপত্যকাতেও শাসকের ক্ষমতালিপ্সা, ঘৃণা ও জনগণমনর মস্তিষ্ক প্রক্ষালনচর্চা চলছে পুরোদমে। ‘বিকাশ’-এর মেষপালকের পোশাকের ভেতরে যে নেকড়ের স্পৃহা আত্মগোপন করেছিল, ভারতবাসী ২০১৪ সালে তা আদৌ বুঝতে পারেনি। তার পরেও কি বুঝতে পারল! বরং বল্লভভাইয়ের মূর্তিস্থাপন, বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির বানানো এবং কাশ্মীরিদের স্বাভিমানকে মিলিটারি কাঁটামারা জুতোর তলায় বীভৎস কাদার পিণ্ড করে দেওয়াটাকেই সে ‘বিকাশ’ ভাবল; উন্নততর ভারতবর্ষ ভাবল।

নোটবন্দির আস্ফালনে তার ব্যবসা সর্বস্বান্ত হল, জিএসটি ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ বসাল। তবু গোমাংসের মিথ্যা অভিযোগে সারা ভারতজুড়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে পিটিয়ে মারাটাই সম্ভবত সংখ্যাগুরুকে তৃপ্তির ঢেকুর তোলাল। গৌরী লঙ্কেশ, কালবুর্গি, পানেসরের মৃত্যুতে সে বিচলিত হল না, বরং অমর্ত্য সেন, স্বরা ভাস্বর ও যে-সকল চিন্তাশীল মানুষ ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রতিবাদ করল, হোয়াটসআপ-শিক্ষিত ভক্ত জনগণ তাদের সব্বাইকে তুলোধুনো করতে লাগল। ‘মোদি ছাড়া আর আছে কি’– এই স্বগতোক্তি আউড়ে ভারতবাসী আবারও ২০১৯-এ বিজেপিকে ক্ষমতায় আনল। কেন না, সমবায়িত গোদি  মিডিয়া তাকে কল্পনায় ৩০০ জঙ্গি খতমকারী যুদ্ধ জয়ের স্বাদ দিয়েছে, ‘উরি’ ফিল্ম তাকে ‘হাই জোশ’ দিয়েছে। তাই ভারতবাসী বালাকোটের সৈন্যমৃত্যুতে নিরাপত্তার প্রশ্নে নিজেদের সামিল করল না। বরং সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে মুগ্ধ রাজভজনায়  সামিল হল। স্যাটেলাইটে ধরা পড়া বৃক্ষ পতনের ছবি নিয়ে কেউ কথা বললেই ‘দেশদ্রোহী’ অভিধায় তার ওপরে ভক্তের আক্রমণ চলল দেশজুড়ে। অতঃপর, ২০১৯-এ ৫৬ ইঞ্চির ভারত-বিজয় সম্পন্ন হল।

- Sponsored -

তারপর মাসের-পর-মাস কাশ্মীরিদের ইন্টারনেট, জীবিকা প্রবাহ বন্ধ রাখার কল ‘৩৭০ ধারা’  জারি হল। কাশ্মীর ভূস্বর্গ হলেও আবালবৃদ্ধবনিতা কাশ্মীরিদের এই দুর্দশাতে অবশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতবাসী দিলখুশ, কেননা কাশ্মীর মানেই ‘আতঙ্কবাদী’। গোদি মিডিয়ার সান্ধ্য চিৎকার এবং বলিউডি ‘মশালা ফিল্ম’ তাকে তাই শিখিয়েছে। সাম্প্রতিক আমলের বিকৃত ঐতিহাসিক ফিল্মগুলিতেও মুসলিম বিদ্বেষের পিলারগুলিতে যত্ন করে ঢালাই মারা হয়েছে। কেশরী, তানাজি, পা‌নিপথ, মণিকর্ণিকা্, পদ্মাবত — সব ফিল্মগুলিতেই পিচ-কালো ভিলেন চরিত্রে মুসলিম শাসকের অন্যায় আগ্রাসন, নারী লোলুপতা, নারীহত্যা ও তার বিরুদ্ধে ত্রিভুজাকৃতি গেরুয়া পতাকা সম্বলিত ন্যায়পরায়ণ হিন্দু যোদ্ধাদের সংগ্রাম প্রদর্শিত হয়েছে সি-শার্পে। শাসকদলের বিস্ময়কর কৃতিত্ব হল এনআরসি ও ক্যা-এর মতো দুটো বাস্তব বর্জিত পরিকল্পনায় ভারতবাসীকে আলোড়িত করা। যদিও ক্যা ভারতবর্ষে লোক ঢোকানোর পদ্ধতি, আর এনআরসি আদতে মুসলিম তাড়ানোর ফন্দি। অসমে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ১৭ লাখ মানুষ বিপর্যস্ত হওয়া সত্বেও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি বিজেপির এই মিছিলে সামিল হয়েছে। তাদের মনে আসলে এই বিশ্বাস রয়েছে যে, বিজেপি যখন করছে তখন মুসলিমরা নিশ্চিত ‘টাইট’ খাবে। আর তাতেই তাদের উল্লাস।

 

করোনার সংকটকালে তালি-থালি-বাতিতে ভারতবাসী তার ভক্তির ‘একতা’ দেখিয়েছে। নাটকীয় লকডাউন ঘোষণার মূঢ়তায় পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যুও ভারতবাসীকে অতটা ক্ষিপ্ত করেনি রেশনের চাল বিতরণে ব্যক্তি-বিচ্যুতি যতটা অধীর করেছে। সরকারের ধান ভানা কিন্তু দিব্য চলছে। ‘নমস্তে ট্রাম্প ’ আয়োজন করে, আন্তর্জাতিক উড়ানগুলির অবাধ বিচরণ বজায় রেখে, মধ্যপ্রদেশের সরকার ফেলার কু-নাট্যে সামিল হয়ে কোভিড ছড়ানোর প্রাথমিক কাজ সমাধা করে রাখা হয়েছে। চার মাস লকডাউনের সময় পেয়েও দেশজুড়ে চিকিৎসা পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারল না সরকার। এরই মাঝে রেল বেসরকারিকরণ, কয়লাখনি বেচে দেওয়া, ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণ, বয়স্ক মানুষের সঞ্চয় সুদ কমিয়ে দেওয়া এবং সাফুরা, ভারভারা রাও-এর মতো যাবতীয় প্রতিরোধী সাহসী ব্যতিক্রমী কণ্ঠগুলোকে নির্মমভাবে জেলে পুরে ফেলা চলছে হর্সপাওয়ার উদ্যোগে।

ইডিকে লেলিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কেস দেওয়া, কাশ্মীরের প্রাক্তন সহযোগী মন্ত্রীদের গৃহ কারাবাসের ব্যবস্থা করা, শচীন পাইলটকে ভাঙিয়ে এনে রাজস্থানের সরকার ফেলে দেওয়ার চেষ্টা তাতেও ব্যস্ততা পুরোদস্তুর। কোটি কোটি টাকার এলইডি লাগিয়ে বাংলায় ভোট প্রচারও হয়ে গেল অমিত বিক্রমে। গালওয়ান উপত্যাকায় বেশ কিছু অংশ এই লেখার সময়ও চিনের অধিকারে। প্রধানমন্ত্রী যদিও তা বেমালুম চেপে যাচ্ছেন। ধামাধরা মিডিয়াও তাতে সায় দিচ্ছে। আমজনতার অবশ্য এসবে বিশেষ হেলদোল নেই। সে যে প্রাণ বাঁচানোয় ব্যস্ত। পিএম কেয়ারের টাকা রাজ্যে কত এল, আমফানে কেন্দ্র কী করল– তা নিয়েও রাজ্যবাসী ভাবিত নয়। তাদের ‘নন্দ ঘোষ’ সামনে পাওয়া সরকার। এদিকে রাজ্যেও দেশের ধনীতম পার্টিটির ছোট-বড় মিডিয়া হাউস কেনা শুরু হয়ে গেছে। পাবলিক সে মিডিয়াকেই চা দিয়ে খায়, তারা জানে। রামচন্দ্র খুশি হচ্ছেন তো?

শোভন সেন : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক (মতামত ব্যক্তিগত)
ছবি ঋণ : ইন্টারনেট

Subscribe to our Whatsapp Group for daily news alerts.


You might also like

- sponsored -

Comments are closed.