বাবরি রায়ে সিবিআইয়ের উপর ভরসা হারাবে মানুষ, মত বিভিন্ন মহলের
বীরেন ভট্টাচার্য, নয়াদিল্লি
বাবরি মামলায় প্রায় তিন দশকের তদন্ত শেষে চূড়ান্ত রায়দানে সুপ্রিম কোর্টের থেকে দেশের সব চাইতে বড় তদন্ত সংস্থাকে শুনতে হয়েছে, তাদের দাখিল করা নথিতে কোনও প্রামাণ্য তথ্য নেই। এরফলে সিবিআই কার্যত মূষিক প্রসব করেছে বলেই সুপ্রিম রায়ের পর মনে করছেন আইনজীবী থেকে শুরু করে অবসরপ্রাপ্ত আইপিএসরা। কোথায় গলদ ছিল, কেন সিবিআইকে এমন কথা শুনতে হল– তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। প্রাক্তন আইপিএস পঙ্কজ দত্ত মনে করেন, “শুরুতেই গলদ ছিল, আর সেই গলদটা হল, বড় সময়ের ব্যবধান। লিবারহন কমিশনকে যেখানে তিন মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছিল, সেখানে ১৭ বছর পর তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয় লিবারহন কমিশন।” অর্থাৎ সময়ে তদন্ত শেষ না করা যে সিবিআইকে অনেকটাই ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে, তা জানান অন্যতম এই পুলিশকর্তা।
৬ ডিসেম্বর ১৯৯২-এ, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঠিক ১৯ দিন পর ১৬ ডিসেম্বর অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এমএস লিবেরহানের নেতৃত্বে এক সদস্যের কমিশন গঠন করা হয়। তিন মাসের মধ্যে লিবারহান কমিশনকে তদন্ত শেষ করে রিপোর্ট দিতে বলা হলেও, মোট ৪৮ বার সেই সময়সীমা বাড়ানো হয়। অবশেষে ৮০ মিলিয়ন অর্থ ব্যয়ে ১৭ বছর পর ২০০৯-এর ৩০ জুন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে রিপোর্ট জমা দেয় লিবারহান কমিশন। পঙ্কজ দত্ত বলেন, “প্রশ্ন হল, কে ভাঙল বাবরি মসজিদ? হয় করসেবক, নাহলে গুন্ডা, অথবা বহিরাগত গুন্ডা। পুলিশ তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে পারত, অথবা সিবিআই সেই কাজটা করতে পারত। সিবিআই যে চার্জশিট দিয়েছে তাতে এত বেশি ফাঁক-ফোঁকর ছিল, সেগুলোই তুলে ধরেছেন বিচারক।”
বিচারকের রায়ের অনেক ক্ষেত্রেই অসন্তোষ প্রকাশ করে পঙ্কজ দত্ত মনে করেন, বিচারক এসকে যাদব সিবিআইয়ের উদ্দেশে যে কথাগুলি বলেছেন, তা দেশের সবচেয়ে বড় এবং প্রিমিয়ার তদন্ত সংস্থার পক্ষে ভাল হয়নি। পাশাপাশি সিবিআইয়ের ডিরেক্টর বা কোনও মুখপাত্র কেন তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে কিছু জানালেন না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এই অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস আধিকারিক। তাঁর মতে, “সিবিআইয়ের বলা উচিত ছিল, আমাদের তদন্ত সঠিক ছিল, এই রায়ের বিরুদ্ধে আমরা স্পেশাল রিভিশনে যাব।” অর্থাৎ এদিনের রায়ের পর, সিবিআইয়ের নীরবতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। এই দিনটিকে ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে কালো দিন বলে মন্তব্য করে পঙ্কজ দত্ত বলেন, দেশের মানুষ যত দ্রুত এই দিনটিকে ভুলে যেতে পারবেন, ততই মঙ্গল।
অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তীর্থঙ্কর মুখোপাধ্যায় মনে করেন, দীর্ঘ ২৮ বছর সময়ের ব্যবধান এর অন্যতম কারণ। তিনি মনে করেন, “এর ফলে অনেক সাক্ষী মারা গেছেন, অনেক তথ্য প্রমাণ নষ্ট হয়েছে। তার ফলে অনেক ফাঁক-ফোঁকর থেকে গিয়েছে।” তিনি মনে করেন, এক্ষেত্রে সিবিআইয়ের মতো দেশের অন্যতম তদন্ত সংস্থা হওয়ার কারণে, তাদের তদন্ত আরও দ্রুত শেষ করা উচিত ছিল। অন্যদিকে, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী পীযূষ রায় মনে করেন, “বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয় পিভি নরসিমহা রাওয়ের আমলে, তখন তো সিবিআইয়ের নিরপেক্ষতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। এতদিন পর সিবিআইয়ের নিরপেক্ষতা নিয়ে কেন প্রশ্ন উঠল?” তিনি মনে করেন, ”কংগ্রেস আমলে সেই সময়েই তো চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে, তখনই তো নথি জমার কাজ করা হয়েছে, এতদিন তো শুধু শুনানি চলছিল। তাহলে কংগ্রেস কীভাবে রায় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে?”
সিবিআই দেশের অন্যতম তদন্ত সংস্থা, দেশের ছোট-বড়ো বিভিন্ন ঘটনায় বারবার সিবিআই তদন্তের দাবি তোলা হয় বিভিন্ন মহল থেকে। তার মধ্যে দিয়েই দেশের এই বৃহততম তদন্তকারী সংস্থার ওপর আশা-ভরসা রাখতে দেখা গিয়েছে। বিভিন্ন ঘটনার তদন্ত করে সমাধান এবং দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করেছে তারা। তবে তার মধ্যেই কখনও ‘খাঁচায় বন্দি তোতা পাখি’, কখনও প্রামাণ্য তথ্য নেই শুনতে হচ্ছে সিবিআইকে। তার ফলে দেশের বৃহত্তম তদন্ত সংস্থার কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
Comments are closed.