কণ্ঠ মাদকতা ছড়িয়ে মেলোডি কুইন আশা ভোঁসলে
সুদীপ চট্টোপাধ্যায়
ভারতীয় সংগীতের এক উজ্জ্বলতম নাম আশা ভোঁসলে (Asha Bhosle)। গজল থেকে পপ কিংবা রবীন্দ্রসংগীত থেকে ক্যাবারে– সবেতেই এই অশীতিপর ভার্যা যেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এককথায় সংগীত জগতের এক জীবন্ত কিংবদন্তির নাম আশা ভোঁসলে। দীর্ঘ ছয় দশকের বেশি সময় ধরে তিনি একটার পর একটা হিট গানের মাধ্যমে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। আজও তিনি এই ৮৭ বছর বয়সে সুরে সুরে সম্মোহিত করে চলেছেন শত কোটি শ্রোতাদের।
১৯৩৩ সালে আজকের দিনে মহারাষ্ট্রের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হয় আশা মঙ্গেশকরের। বাবা দীননাথ মঙ্গেশকরের কাছেই প্রথম গানের পাঠ শুরু। দিদি লতা মঙ্গেশকর ছোট থেকেই গানকে জীবনের পথ হিসেবে বেছে নিলেও আশার চিন্তা ছিল অন্যরকম। কিন্তু মাত্র ৯ বছর বয়সেই আশা বাবাকে হারালেন। তখন থেকেই তার শুরু হল এক কঠিন জীবনযুদ্ধ। আর সেই যুদ্ধে তিনি অস্ত্র হিসেবে বেছে নিলেন গানকেই। নিজের মিউজিক্যাল ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে পায়ের তলায় মাটি পেতে বেশ লড়াই করতে হয়েছিল আশা ভোঁসলেকে। কারণ সেই সময় তার দিদি লতা মঙ্গেশকর এবং গীতা দত্তের মতো বেশ কিছু সংগীতশিল্পী জাঁকিয়ে বসে ছিল বলিউডে। ফলে এরাই পেতেন ছবির নায়িকার গান আর আশা পেতেন খলনায়িকা বা অপ্রধান চরিত্রের গান। কিন্তু তাতেও থেমে থাকেননি আশা ভোঁসলে। সেই সময় বেশকিছু লো-বাজেট বা বি-গ্রেড সিনেমাতেও প্লেব্যাক করেছেন তিনি। ৫-এর দশকের শুরুতেই ‘সংদিল’ ছবিতে গান গেয়ে কিছুটা সম্মান কুড়িয়ে পান আশা।
রাজ কাপুরের ‘বুট পালিশ’ ছবিতে প্রথমবার মহম্মদ রফির সঙ্গে প্লেব্যাক করার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাতারাতি অখ্যাত থেকে খ্যাত হয়ে ওঠেন আশা ভোঁসলে। এরপর ৫-এর দশকের শেষদিকে বিখ্যাত মিউজিক পরিচালক ওপি নায়ার তাঁকে সুযোগ দিয়েছিলেন ‘সিআইডি’, ‘নয়া দৌড়’, ‘হাওড়া ব্রিজ’ প্রভৃতি ছবিতে নায়িকার কণ্ঠে গান গাওয়ার। তারপরে শুধু ওপরে ওঠা, আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
‘তিসরি মঞ্জিল’ ছবির মধ্যে দিয়ে তিনি জুটি বাঁধেন আর এক বিখ্যাত সুরকার আরডি বর্মণের সঙ্গে। পঞ্চমের সংস্পর্শে বদলে যায় তার নিজ জীবন থেকে কেরিয়ার সব কিছুই। ৬-৭ দশকে আরডি-আশার জুটি বলিউডকে অসংখ্য সুপারহিট গান উপহার দিয়েছে। এইসময় বলিউড আইটেম কুইন হেলেনের ভয়েস হয়ে ওঠে আশার সুমধুর কণ্ঠ। ‘পিয়া তু’ থেকে ‘ইয়ে মেরা দিল’ বা ‘ও হাসিনা জুল্ফওয়ালি’ যেখানেই হেলেনের ক্যাবারে সেখানেই আশার সুরেলা কণ্ঠ মাদকতা ছড়িয়েছে সিলভার স্ক্রিনে। পঞ্চমের সান্নিধ্যে এসে তিনি বদলে দেন ভারতীয় সংগীতের ধারাকেও। দেশ-বিদেশের শ্রোতারা প্রত্যক্ষ করে গানের এক নবযুগকে। শুধু হিন্দি নয়, রবীন্দ্রসংগীত থেকে নজরুল গীতি, বাংলা সিনেমার গান থেকে পুজোর গান গেয়ে আশা ভোঁসলে আজ বাঙালির প্রিয় শিল্পীদের একজন হয়ে উঠেছেন।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে গণপতরাও ভোঁসলেকে বিয়ে করলেও পরবর্তীকালে সংগীত পরিচালক রাহুল দেব বর্মণকে বিয়ে করেন আশাজী। ফিল্মফেয়ার, জাতীয় পুরস্কার, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার প্রভৃতি সব পুরস্কারই আজ তাঁর করায়ত্ব। অশীতিপর এই তরুণীর কণ্ঠে আজও নেচে ওঠে আপামর ভারতবাসীর হৃদয়। কঠোর সাধনা, গভীর অধ্যাবসায় আর অসীম মানসিক জোরের মাধ্যমে জীবনের চড়াই-উতরাইকে টপকে সামান্য এক বি-গ্রেড সিনেমার প্লেব্যাক সিঙ্গার থেকে আজ তিনিই হয়ে উঠেছেন মেলোডি কুইন অফ বলিউড।
Comments are closed.