Bengal Fast
বিশ্ব মাঝে বাংলা খবর

‘লাভ জেহাদ’– এর সঙ্গে ধর্মের কোনও যোগ নেই

নারী-পুরুষের যে প্রেম, তা কি কখনও ধর্ম বিচার করে ভেবেচিন্তে হয়? প্রেমের সম্পর্ক নীরবে নিঃশব্দে গড়ে ওঠে। ‘লাভ জেহাদ' বলে সোচ্চার হওয়ার আসল ব্যাপারটাই হল, হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ভোট ভাগ করা। প্রেম, বিয়ে মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। সেখানে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। নিবিড় বিশ্লেষণে বিশিষ্ট সমাজকর্মী লেখিকা রোশেনারা খান।

রোশেনারা খান

সম্প্রতি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত স্বর্ণ বিপণীর বিজ্ঞাপনকে ঘিরে যে অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে গেল তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের ঘৃণ্য বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই না! ঘটনাটি সাময়িকভাবে হলেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে আঘাত হেনেছে। একদল দুষ্কৃতী ওই কোম্পানির গহনার দোকানে ভাঙচুর চালানোয়, কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞাপনটি তুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন। বিজ্ঞাপনটিতে দেশ তোলপাড় করার মতো আদৌ কি কিছু ছিল? একটি মুসলিম পরিবারে হিন্দু বউমার জন্য হিন্দুরীতি মেনে সাধভক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে। বধূটি অবাক হলে শাশুড়ি জানান, তারা মেয়ের(বউমা) খুশির জন্য এসব করেছেন। বিজ্ঞাপনটি মোটামুটি এইরকম। নিরপেক্ষভাবে দেখলে বিজ্ঞাপনটিতে সম্প্রীতির বার্তা রয়েছে। কিন্তু কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিমদের সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের সুসম্পর্ক একবারেই চায় না। তাই সুযোগ খোঁজে যেনতেন প্রকারে এই সুসম্পর্ক নষ্ট করার।

এতে দেশের বা জনগণের লাভ তো কিছু হচ্ছেই না, বরং বলা যায় এরা আমাদের পিছনে টানছে। পিছিয়ে পড়ছে আমাদের দেশ। একটা কাল্পনিক কাহিনি নিয়ে এরা সারা দেশে বিদ্বেষের বিষ ছড়ানোর চেষ্টা করায় বিজ্ঞাপনটি বন্ধ করে দিতে হল। এটা দেশের পক্ষে কম লজ্জার? যে দেশে কবীর, শ্রীচৈতন্য, লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলরা জন্মেছেন– যাঁরা ভারতবর্ষের বৈচিত্র্যতাকে ‘মহান’আখ্যা দিয়ে কবিতায়, গানে, উপদেশে সম্প্রীতির কথা বলে গেছেন, সে দেশে রাজনৈতিক স্বার্থে একদল লোক দেশের ঐক্য নষ্ট করতে চাইছে! এই ধর্মান্ধতা, বিদ্বেষকে পশ্চাৎপসারণ ছাড়া আর কী বলা যায়?

নবাব মনসুর আলি খান পতৌদির সঙ্গে ঠাকুর পরিবারের মেয়ে শর্মিলা ঠাকুর

কোনও বিজ্ঞাপন বা কল্পকাহিনি নয়, বাস্তবে আমাদের দেশে হিন্দু-মুসলিম বিয়ে হয়েই থাকে। সেটা অবশ্যই প্রেমজ বিয়ে। তবে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের মেয়ে অন্নপূর্ণা (রওশনআরা) ও বিশ্বখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করের ভাই এবং আলাউদ্দিন খানের ছাত্র রবিশঙ্করের বিয়ের নাকি ঘটকালি করেছিলেন রবিশঙ্করের দাদা-বউদি। ওনারাই আলাউদ্দিন খানের কাছে ভাই রবির সঙ্গে অন্নপূর্ণার বিয়ের প্রস্তাব রেখেছিলেন। দুই পরিবারের সম্মতিতে এই বিয়ে হয়েছিল ১৯৪১ সালে। ভারতের তৎকালীন ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন নবাব মনসুর আলি খান পতৌদির সঙ্গে কলকাতার ঠাকুর পরিবারের মেয়ে অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুরের বিয়ে হয়েছিল   ১৯৬৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ঠাকুরবাড়িতেই। নাখোদা মসজিদের ইমামকে ঠাকুরবাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল। তিনি এসে শর্মিলার ধর্ম এবং নাম (আয়েশা সুলতানা) পরিবর্তন করে এই বিয়ে দিয়েছিলেন। দুই পরিবারেই প্রথম দিকে আপত্তি থাকলেও পরে দুই পক্ষই বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন। এই বিয়ে উচিত কি অনুচিত, তা নিয়ে বাইরের কাউকে মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি।

ওস্তাদ আমজাদ আলি খানের সঙ্গে শুভলক্ষ্মী বড়ুয়া

- Sponsored -

ওস্তাদ আমজাদ আলি খান ও নৃত্যশিল্পী শুভলক্ষ্মী বড়ুয়ার বিয়ে হয় ১৯৭৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। আমজাদ আলি খানের এটি দ্বিতীয় বিয়ে। বিয়ের পর শুভলক্ষ্মী নাচ ছেড়ে দিয়ে সংসার ও সন্তান লালন-পালনের মধ্যে নিজের জগতকে সীমাবদ্ধ রাখেন। ওহাইদা রহমান বিয়ে করেছেন কমলজিত সিংহকে, নার্গিস করেছিলেন সুনীল দত্তকে। সঞ্জয় দত্ত মুসলিম মেয়ে বিয়ে করেছেন এবং সেই স্ত্রী হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেছেন। এছাড়াও আমির খান, সইফ খান, শাহরুখ খান, ইরফান খানরা তো কেউ কেউ একাধিক হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছেন। হিন্দুত্ববাদের পীঠস্থানে বসে হিন্দু নারী-পুরুষ বিধর্মীকে (মুসলিম) বিয়ে করে দিব্যি আছেন তাঁরা। তাঁদের বেলায় কিন্তু ‘লাভ জেহাদ’-এর তত্ত্ব প্রয়োগ করা হয় না। আসলে সমাজের ওপরতলার মানুষের প্রভাব-প্রতিপত্তির সঙ্গে এরা এঁটে উঠতে পারবে না জেনেই শামুকের মতো খোলের ভিতরে মুখ লুকিয়ে থাকে। এদের আপত্তি অশোক টোডি ও রিজুয়ানুরের মতো অর্থ কৌলীন্য ও প্রভাব প্রতিপত্তির দিক দিয়ে যারা সমতুল্য নয়, তাঁদের ক্ষেত্রে।

কমলজিত সিংহের সঙ্গে ওহাইদা রহমান

এখানে কয়েকটি বিষয় ভেবে দেখলে পুরো ব্যপারটাই জলের মতো স্বচ্ছ হয়ে উঠবে। নারী-পুরুষের যে প্রেম, তা কি কখনও ধর্ম বিচার করে ভেবেচিন্তে হয়? প্রেমের সম্পর্ক নীরবে নিঃশব্দে গড়ে ওঠে। ধর্ম আলাদা হলে পরিবারের আপত্তির কারণে অনেক সময় প্রেম বিয়ে পর্যন্ত পৌঁছায় না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই বিয়ে বাড়ির অমতেই হয়। মুসলিম যুবকের সঙ্গে হিন্দু যুবতীর বিয়ে যে সংখ্যায় হয়, তার চেয়ে কমই মুসলিম যুবতী ও হিন্দু যুবকের বিয়ে হয়ে থাকে। এর প্রথম কারণ মুসলিম পরিবারে হিন্দু যুবতীকে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে খুব একটা আপত্তি দেখা যায় না। মেয়েটি যদি ইসলামধর্ম গ্রহণ করে, তাহলে তাঁকে সাদরেই গ্রহণ করা হয়। না করলেও তাঁকে রান্নাঘরে বা অন্য কোথাও প্রবেশে নিষেধ থাকে না। কিন্তু ছেলের মুসলিম স্ত্রীকে বেশিরভাগ হিন্দু পরিবারে রান্নাঘরে বা ঠাকুরঘরে প্রবেশ করার অনুমতি দেয় না। তাছাড়া বেশিরভাগ মুসলিম পরিবারের মেয়েরা কঠোর অনুশাসনে বড় হয়। তদের মধ্যে শিক্ষার হার খুবই কম। সেই কারণে তাদের ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগও কম। হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে আরও কম। তাই বিয়েটাও কম হয়। কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা হিন্দু যুবতীর সঙ্গে মুসলিম যুবকের প্রেম ও বিয়েকে যে ‘লাভ জেহাদ’বলে প্রচার করছে, তা খুবই হাস্যকর। কারও ধর্ম নষ্ট করার বা নিজেদের জনসংখ্যা বাড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়ে মুসলিম যুবকরা জেহাদের (ধর্মযুদ্ধ) জন্য হিন্দু যুবতীদের সঙ্গে প্রেম করে, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? সবাই নিজের মতো করে জীবন কাটাতে চায়। সাধারণ মানুষ এসব জেহাদ ইত্যাদি নিয়ে ভাবে না। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই বিদ্বেষ বিষ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মনে গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আরও একটি ব্যাপারেও একই অপপ্রচার চালানো হয়। সেটা হল মুসলিমরা অধিক সন্তানের জন্ম দেয় এদেশে তাদের জনসংখ্যা বাড়ানোর জন্য। এই যুক্তিটিও হাস্যকর। যারা একথা বলে থাকেন, তারা ক’জন শিক্ষিত মুসলিম দম্পতির অধিক সন্তান দেখেছেন? এদেশে এবং রাজ্যে মুসলিমদের শিক্ষার হার কম বলেই তাঁরা জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সম্বন্ধে বিশেষ অবগত ছিল না। ইদানীং সরকারি উদ্যোগে বাড়ি বাড়ি প্রচারের ফলে মানুষ সচেতন হচ্ছে, কমছে জন্মহার। মানুষ সুখ চায়, শান্তি চায়। কারও দায় পড়েনি দেশে মুসলিমদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য নিজের পরিবারের সুখশান্তি জলাঞ্জলি দেবে। এটুকু তারা বোঝে, তার ছেলেমেয়েকে মানুষ করার দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে।

সুনীল দত্তের সঙ্গে নার্গিস

আসল ব্যাপারটা হল, হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ভোট ভাগ করা। আর ‘লাভ জেহাদ’-এর নামে স্বর্ণবিপণীতে ভাঙচুর চালিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করার পিছনে উদ্দেশ্য হল দেশের জনগণের মন হাতরাসের ঘটনা-সহ সরকারের আরও অনেক জনবিরোধী সিদ্ধান্ত থেকে অন্যদিকে চালিত করা। আর একটা কথা, যদিও ঘটনাটি আমাদের দেশের নয়, তবুও অন্যায়টা অন্যায়ই। তাই তার প্রতিবাদ হওয়াটাও উচিত। মহম্মদের কার্টুন দেখানোর জন্য কোনও শিক্ষকের গলা কেটে ফেলা– শুধু অন্যায় নয়, অপরাধও। এখানে ধর্মের কোনও ভূমিকা নেই।

প্রেম, বিয়ে মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। সেখানে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এর সঙ্গে ধর্মেরও কোনও যোগ নেই। ধর্ম যে-যার নিজের বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে। দেশের সংবিধানে কাউকে ধর্ম মানতেই হবে, এমন নির্দেশ নেই। দুটি ভিন্ন ধর্মের নারীপুরুষকে বিয়ের পর যে-যার নিজের ধর্ম পালন করতে দেখা যায়। এরা সন্তানের ক্ষেত্রে বলেন, ১৮ বছরের পর ওরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে কোন ধর্ম পালন করবে বা আদৌ কোনও ধর্ম পালন করবে কিনা। আবার অনেক দম্পতি উভয় সম্প্রদায়ের উৎসবে সামিল হন, কিন্তু ধর্মীয় আচার মানেন না। তাই সবসময়, সবক্ষেত্রে আমাদের বিবেককে কাজে লাগাতে হবে। প্রয়োজনে আমার প্রতিবেশীই আগে এগিয়ে আসবেন, তিনি হিন্দু হন বা মুসলিম। আসুন না, আমরা সব পরিচয়কে মুছে ফেলি। ‘আমরা মানুষ’এটাই আমাদের প্রথম এবং শেষ পরিচয় হোক। তবেই সমস্ত অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করা সম্ভব হলেও হতে পারে। সেটা নির্ভর করছে আমাদের সদিচ্ছার ওপর। ভুললে চলবে না, দেশটা আমাদের। নেতা-মন্ত্রীদের আমরাই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছি। সে কাজে তাঁরা ব্যর্থ হলে আমাদের উচিত যোগ্য  ব্যক্তিকে নির্বাচন করে নিজেদের দেশকে রক্ষা করা।

 

রােশেনারা খান : সমাজকর্মী ও লেখিকা। মতামত ব্যক্তিগত। ছবি ঋণ : ইন্টারনেট

Subscribe to our Whatsapp Group for daily news alerts.


You might also like

- sponsored -

Comments are closed.