অফুরান অভিনয়-খিদের নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
সুদীপ চট্টোপাধ্যায়
জীবনকে আলাদা ভাবে দেখতে শিখিয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা চলচ্চিত্রকে নতুন ধারায় প্রভাবিত করেছেন তিনি। ক্ষুদ্র মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে জীবনকে দিয়েছেন এক নতুন রূপ। সাধারণ থেকে হয়ে উঠেছেন অসাধারণ এক প্রতিভা, যাঁর অভিনয়ের বিচ্ছুরণ ঘটেছে বাংলা ছবির খিড়কি থেকে সিংহদুয়ারে।
১৯৩৫ সালে কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা ছবির এই মহান অভিনেতা। ছেলেবেলা থেকেই বেশ মেধাবী ছিলেন বাবা-মায়ের আদরের ‘পুলু’। আর-পাঁচজনের মতো তাঁরও লক্ষ্য ছিল জীবনে বড়-হয়ে-ওঠা। সেই স্বপ্ন পূরণ করতে কৃষ্ণনগর থেকে তিনি শহর কলকাতার দিকে পা বাড়িয়েছিলেন। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর হন তিনি। এরপর অভিনয়ের ইচ্ছা থাকলেও পেটের খিদে মেটাতে অল ইন্ডিয়া রেডিও-য় ঘোষক হিসাবে যোগদান করেন।
তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়, যখন আলাপ হয় বিশ্ববরেণ্য চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। ১৯৫৯ সালে সত্যজিতের হাত ধরেই ছবির জগতে পা রাখেন ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি লম্বা, দোহারা চেহারার বছর ২৪-এর সৌমিত্র। ছবির নাম ‘অপুর সংসার’। অপু ট্রিলজির শেষ ছবিতে প্রথমবার অভিনয় করেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। এবং রাতারাতি হয়ে ওঠেন বিখ্যাত। এই ছবির অপু ধীরে-ধীরে হয়ে ওঠেন সত্যজিতের প্রিয় নায়ক। একে-একে মুক্তি পেতে লাগল সত্যজিতের অমর সৃষ্টি, স্বপ্নের সফর আর তাতে সত্যজিতের নায়ক সেই সৌমিত্রই।
সত্যজিতের পরিচালনা ও সৌমিত্রর অভিনয়গুণে আসতে লাগল দেশ-বিদেশের স্বীকৃতি। শোনা যায়, সৌমিত্রকে সামনে রেখেই নাকি সত্যজিৎ রায় তার বিভিন্ন চরিত্র সৃষ্টি করতেন! কারণ তাঁর মাঝেই সত্যজিৎ খুঁজে পেয়েছিলেন সম্পূর্ণ বাঙালিকে, যেখানে ছিল না কোনও ভণিতা, ছিল না কোনও অস্পষ্টতা। আর এর অন্যতম নিদর্শন ‘ফেলুদা’। ফেলুদা, ওরফে গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্রকে যে প্রতিটি বাঙালি মনের মনিকোঠায় রেখে দিয়েছেন এবং তা যে সৌমিত্রর জন্যেই, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সাতের দশকে ‘সোনার কেল্লা’ এবং ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ তাঁকে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। এই পর্বের আগে ও পরে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস-আশ্রিত ‘চারুলতা’ ও ‘ঘরে বাইরে’-তে তাঁর অভিনয় গোটা বাংলার দর্শককে প্রভাবিত করেছিল। আবার ‘শাখা-প্রশাখা’, ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে আমরা দেখতে পাই অন্য এক সৌমিত্রকে। তবে শুধু সত্যজিৎ রায় নয়, পরিচালক মৃণাল সেন এবং তপন সিংহের সঙ্গেও তার বেশ কিছু অমর সৃষ্টি রয়েছে। মৃণাল সেনের ‘আকাশকুসুম’ ছবিতে আমরা পেয়েছি অন্য এক সৌমিত্রকে। আবার সরোজ দে-র ‘কোনি’ ছবিতে দেখেছি সাঁতার-প্রশিক্ষকের ভূমিকায় তাঁর দুরন্ত অভিনয়।
তবে শুধু অফবিট ছবিতে নয়, তাঁর স্পোর্টসম্যান-সুলভ সুদর্শন চেহারা ও সুললিত কণ্ঠের জন্য সিলভার স্ক্রিনে তাঁকে রোমান্টিক ভূমিকায় বারবার দেখা গেছে। আর এখানেই তিনি টক্কর দিয়েছেন মহানায়ক উত্তমকুমারের সঙ্গে। সেই সময়ে ইন্ডাস্ট্রি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বাংলা ছবির মহানায়ক উত্তমকুমার, তবুও তার মাঝে তিনি নিজস্ব জায়গা করে নেন। হয়ে ওঠেন বাংলা ছবির এক অনন্য আইকন। তবে উত্তম-যুগে নিজেকে আলাদা ইমেজ দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করেননি সৌমিত্র।
তাই ১৯৬১-তে ‘ঝিন্দের বন্দী’ ছবিতে খলনায়কের চরিত্রে উত্তমকুমারকে কড়া চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতেও পিছপা হননি। অত্যন্ত কঠিন হলেও খলনায়ক ময়ূরবাহনের চরিত্রে স্বমহিমায় উত্তীর্ণ হন তিনি। স্রোতের অনুকূলে যেতে পারে সকলেই, কিন্তু তার প্রতিকূলে গিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার নামই তো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়!
এরপর ‘বসন্ত বিলাপ’ ছবিতে ধরা পড়ল তাঁর কমিক সেন্স-ও। গোটা ছবিতে তার কৌতুকাভিনয় তামাম বাঙালির মন মজিয়ে দিয়েছিল। আবার তনুজা-র সঙ্গে ‘তিন ভুবনের পারে’ ছবিতে ঘরোয়া বাঙালি হিসেবে আমরা তাঁকে পেলাম। রুপোলি পর্দায় সৌমিত্র-তনুজার রোমান্সে কাত সময়ের কলেজ-পড়ুয়ারা! তাই তো আজও প্রতিটি কলেজের ফেস্ট্-এ বেজে উঠে অবিস্মরণীয় সেই গান— ‘কে তুমি নন্দিনী…’। শুধু এ-ই নয়, মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তাঁর জুটি আলাদা জায়গা করে নিয়েছিল বাঙালি দর্শকের কাছে।
এরপর তিনি বাণিজ্যিক ছবি থেকে বেরিয়ে এসে বাঙালি দর্শকদের উপহার দিতে শুরু করেন ‘কোনি’, ‘আতঙ্ক’, ‘পরিণীতা’-র মতো বেশ কিছু
অন্য ধরণের ছবি। সেখানেও চরম সাফল্য। শুধু বাংলা সিনেমা-ই নয়, বাংলা থিয়েটারের-ও একজন সফল অভিনেতা, পরিচালক ও প্রযোজক তিনি।
‘ফেরা’, ‘নীলকণ্ঠ’ থেকে ‘টিকটিকি’ কিংবা ‘রাজা লিয়র’ প্রভৃতি নাটকে তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয় সর্বমহলে। এক কথায় তিনি হলেন বাংলা ছবির অভিনয়ের প্রকৃত এক সাধক। তাই জীবনসায়াহ্নে এসেও মারণ রোগ ক্যান্সারকে উপেক্ষা করে তাঁর বেচে থাকার অক্সিজেনও সেই অভিনয়ই। তাই ‘হুইলচেয়ার’, ‘দেখা’, ‘অসুখ’, ‘বেলাশেষে’-র মতো সুপারহিট ছবিতেও তাঁর অভিনয় দেখেছে বাংলার দর্শক। তিনি হলেন এক কিংবদন্তি। দেশ ছাড়া বিদেশেরও প্রচুর সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে ইতালির লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার।
১৯৭০-এ ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করেছে, ২০০৪-এ পেয়েছেন পদ্মভূষণ, ২০০১ সালে পেয়েছেন স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড-ও। আবার ২০১২-য় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় দেশের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র-সম্মান দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। ওই একই বছর তিনি পান সংগীত নাটক অ্যাকাডেমী পুরস্কারও। ২০১৭ সালে লিজিয়ন দ্য অনার সম্মানে তাঁকে সম্মানিত করে ফরাসি সরকার।
অদম্য জেদ, হার না-মানা মনোভাব, অভিনয়ের প্রতি অপরিসীম ভালবাসা আর যাবতীয় প্রতিকূলতাকে ছাপিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার তাগিদেই নদীয়ার কৃষ্ণনগরের অশীতিপর পুলু আজ গোটা বিশ্বের দরবারে পরিচিত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নামে। আর বাঙালির কাছে তাদের প্রিয় ফেলুদা ওরফে সৌমিত্র চিরকাল থেকে যাবে সৌ-মিত্তির হিসেবেই।
Comments are closed.