Bengal Fast
বিশ্ব মাঝে বাংলা খবর

আর্টের নামে বজ্জাতি

প্রদোষ পাল

পিকাসোর আঁকা পৃথিবীর অন্যতম সৃষ্টি গুয়ের্নিকার রঙিন বিকৃত রূপ মনটাকে রাগে, ক্ষোভে ভরিয়ে তুলল। এই অসভ্যতা কার আমি জানি না, জানতে চাইও না। যে-ই করুক চূড়ান্ত অন্যায় করেছে। এ অপরাধের শাস্তি পাওয়া উচিত। জানি না পিকাসোর পরিবার এই বিকৃতির বিরুদ্ধে কোনও মামলা করেছেন কিনা। না করলে অবশ্যই মামলা করা উচিত।

বিন্দুমাত্র কারও শিল্পবোধ থাকলে বোঝা উচিত পিকাসো কোন পটভূমিতে এই সৃষ্টি করেছিলেন এবং কেন তা রঙিন না করে সাদাকালোতে এঁকেছিলেন।
“One of the most famous 20th century paintings, Guernica was created by Picasso to express his outrage over the Nazi bombing of a Basque city in northern Spain, ordered by General Franco. Since then, this monumental black-and-white canvas has become an international symbol of genocide committed during wartime.”


যে কোনও সৃষ্টির পেছনে থাকে স্রষ্টার গভীর ভাবনা চিন্তা। যদি ছবির ক্ষেত্রই দেখি তাহলে ছবিতে কী রঙ ব্যবহার করবেন তা শিল্পীর নিজস্ব ভাবনার বিষয়। তিনি সাদা কালোতে আঁকবেন, না রঙিন করে তা একান্ত শিল্পীর ব্যক্তিগত ভাবনার ও প্রকাশের জগত। দ্বিতীয় কেউ সৃষ্টি হয়ে যাওয়া সৃষ্টিকে তার মতো যা খুশি করতে পারে না। নিজের সৃষ্টি নিয়ে যা খুশি পরীক্ষানিরীক্ষা সে করতেই পারে, কিন্তু অন্যের সৃষ্টি নিয়ে নিজের মতো যা খুশি করা চূড়ান্ত অপরাধ। অন্তত আমি তাই মনে করি।

কিছুদিন আগে ‘পথের পাঁচালী’র একটা রঙিন ক্লিপ সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরাঘুরি করেছিল। প্রসঙ্গত বলতে পারি ১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায় চাইলেও ‘পথের পাঁচালী’ রঙিন করতে পারতেন না। তিনি যদি আশির দশকের পর ‘পথের পাঁচালী’ করতেন তাহলেও কী সাদাকালোতে করতেন? প্রশ্নটা এখানে। সত্যজিৎ রায়ের ছবির তালিকায় চোখ বোলালে আশির দশকের পর একটা ছবিও রঙহীন চোখে পড়েনি। জোর দিয়ে তাই বলা যায় না পরবর্তী সময়ে ‘পথের পাঁচালী’ রঙিন করতেন না সাদাকালোতে! খারাপ লাগা যেটুকু, একটা ঐতিহাসিক সৃষ্টি, যা বছরের পর বছর মানুষের হৃদয় ভরিয়ে রেখেছে। চোখ মেললেই যেভাবে সে সৃষ্টিকে আমারা দেখে আসছি এতকাল, কোন স্পর্ধায় তাকে নিজের রঙে চুবিয়ে রঙিন করে পরিবেশন করা যায়! একইরকম খারাপ লেগেছিল ‘মুঘল-ই আজম’ রঙিন হওয়ার পর।

- Sponsored -

গুয়ের্নিকার সঙ্গে ‘পথের পাঁচালী’র তফাৎ হল চাইলে সত্যজিৎ রায় পরবর্তী কালে রঙিন করলেও করতে পারতেন, কিন্তু পিকাসো কখনওই গুয়ের্নিকা রঙিন করতেন না। তাঁর সময় রঙ সহজলভ্য ছিল না এমনটা নয়। ছবি আঁকার জগতটা সিনেমার জগতের মতো নয়। পিকাসো জেনে-বুঝে, গভীর ভাবনাচিন্তা এবং বিষয়কে পরিষ্ফুট করতে কোনও রঙ ব্যবহার করেন নি। সেই মহান সৃষ্টিকে এভাবে রঙের মোড়কে বাজারে পেশকরা আইনত দণ্ডনীয়। আমি এই অপকর্মের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

কম্পিউটারে মাল্টিমিডিয়া শিক্ষার শুরুতে শিক্ষানবিশদের পেইন্ট বলে একটা সফটওয়্যার শেখানো হত আমাদের সময়ে। বছর পঁচিশ আগের কথা বলছি। মাউস দিয়ে বিভিন্ন ফর্ম তৈরি করে তার মধ্যে হরেক রঙ ভরে দেওয়া হত। রঙ, ফর্ম নিয়ে বেশ মজা লাগত। বলাইবাহুল্য প্রতিটি রঙ ফ্ল্যাট। বিভিন্ন প্রকার ও ঘনত্বের রঙ হলেও সবই ফ্ল্যাট। কেন যেন গুয়ের্নিকার রঙিন ছবিকে আমার তেমনই পেইন্ট টুল দিয়ে করা মনে হল। বিন্দুমাত্র রঙের গভীরতাহীন একপ্রকার ফ্ল্যাট রঙ ভরা। এক কথায় খুবই কাঁচা একটা কাজ।

মুশকিল হল তথাকথিত পণ্ডিতদের নিয়ে। এই বিদ্যেবোঝাই পণ্ডিতরা এতটাই নিজেদের পাণ্ডিত্যের গরিমায় গর্বিত, অথচ প্রকাশের তেমন সুযোগ না পেলে যেখানে-সেখানে পাণ্ডিত্য গুঁজে দেন। এ ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হবে না মনে হয়। তার সঙ্গে ‘মুক্ত চিন্তা’, ‘স্বাধীনতাকামী’রাও যোগ দেবেন। শিল্প ইতিহাস থেকে কত গালভরা শিল্পীকে যে আমদানি করে বোঝাবেন, যুগে যুগে এমনই কত প্রথা ভেঙেছেন কত শিল্পী। তথাকথিত বিপ্লবীরা গলা কাঁপিয়ে বক্তৃতা ঝাড়বেন ‘কেন শিল্পীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হবে!’

আগেই বলেছি জ্ঞানপ্রকাশের, বিপ্লব দেখানোর মত্ততায় এরা মুক্ত মনে ছবিটা ভাল করে নীরিক্ষণও করে না। সব ক্ষেত্রেই আলাদা করা, অন্যরকম করা বা প্রথা ভাঙাটাই শিল্প নয়। সবাইকে শিল্প গড়ার স্বাধীনতা দিলে ‘চোখে আঙুল দাদা’র কীর্তি হবে। মনে আছে তো সর্বদা জ্ঞান মারা ‘চোখে আঙুল দাদা’ সঠিক মানুষ গড়তে গিয়ে হাতের জায়গায় পা, পায়ের জায়গায় হাত, নাকের জায়গায় চোখ, চোখের জায়গায় কান বসিয়ে কী কাণ্ডই না করেছিল!

প্রদোষ পাল, চিত্রকর, শিল্পসমালোচক, কলামিস্ট, ফোন : +৯১ ৯৮৩০১ ২৯১২৬

Subscribe to our Whatsapp Group for daily news alerts.


You might also like

- sponsored -

Comments are closed.