জয় শ্রীরাম বনাম ছটপূজা, ভোটের রসায়নে কপাল পুড়ছে পরিবেশের!
রূপম চট্টোপাধ্যায়
ভোটের বাজারে পরিবেশের দর এ রাজ্যে তলানিতেই থেকে গেল। ‘সেভ ওয়াটার ডে’-তে যে বৃদ্ধ ভদ্রলোক সরকারি একটি অনুষ্ঠান থেকে বাড়ি ফিরে বলেছিলেন- ‘এবারে হয়তো শহরের সরোবর দুটো বাচঁবে।’ তিনিই গত বছর পরিবেশ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে রবীন্দ্র সরোবরের গেট ভেঙে ছটপূজায় মত্ত এই শহরের বাসিন্দাদের আচরণে হতাশ হয়েছিলেন। তাঁকে অবাক করেছিল সে দিন পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূমিকাও। এবার যখন কলকাতার রক্ষাকর্তা কেএমডিএ নিজেই রবীন্দ্র সরোবরে ছটপূজার অনুমোদন চেয়ে আবেদন করে বসল, তখন এই শহরের পরিবেশ সচেতন মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই আঁতকে উঠছে।
কলকাতার দুটি বৃহৎ জলাশয়, একটি জাতীয় জলাশয় হিসেবে চিহ্নিত রবীন্দ্র সরোবর, অন্যটি উত্তর-পূর্ব কলকাতার সুভাষ সরোবর। দুটিই প্রবল দূষণের শিকার। কলকাতার বাইরে বৃহৎ জলাগুলি যা পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার দিক থেকে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলি বহু দিন থেকেই বিপন্ন। হিন্দমোটর কারখানা সংলগ্ন প্রায় ১৫০ একর জলাভূমি ২০০৬ সালে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে বিড়লা গোষ্ঠী হাতিয়ে নিয়েছে। স্থানীয় সামাজিক সংগঠন ‘গণউদ্যোগ’-এর ধারাবাহিক লড়াই এই জলাকে দীর্ঘদিন ভরাট করতে দেয়নি। সেই লড়াই সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। শেষে ২০১৬-তে সেই জলা ভরাট করে বহুতল আবাসন তৈরি হয়েছে। তবে হাইকোর্টের রায়ে ৩০ একর জলা রেহাই পেয়েছে। বেআইনি ভাবে এই জলাজমি কবজা করতে বাম এবং তৃণমূল দুই সরকারকেই প্রোমোটাররা পাশে পেয়েছে। আসলে সরকার পাশে থাকলে কে কী করবে, আক্ষেপ করছিলেন বৃদ্ধ চাষি সন্তোষ বাগ। আবাসন প্রকল্পের জন্য নিকাশি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় তাঁর চাষের জমির উপর এখন সামান্য বৃষ্টিতেই এক হাঁটু জল দাঁড়িয়ে থাকে। ক্ষমতাসীনদের উন্নয়নের ধারণায় প্রকৃতি-পরিবেশের কোনও স্থান নেই।
একসময় আদি গঙ্গার উপর মেট্রো রেলের পিলার বসিয়ে কলকাতার নিকাশির সর্বনাশ প্রসঙ্গে খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম তৎকালীন মেট্রো রেলের চিফ ইঞ্জিনিয়ার বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের কাছে। ওই পিলার আদি গঙ্গাকে বাঁচিয়েও করা যেত কিনা প্রশ্ন করতেই জানালেন, তিনি আদি গঙ্গা ভরাট করে দেওয়ার পক্ষে। এই হল পরিবেশ সচেতনতার নমুনা। রাজ্যপালের আসন অলঙ্কৃত করার পর এখন তিনি এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন বলে কেউ কেউ বলছেন।
এখনও হুগলির গোঘাটের ৫২ বিঘার ভবাদিঘি ভরাটের অপেক্ষায়। রাজ্য সরকার ভরাটের পক্ষে, বাঁধ সেধেছে স্থানীয় মানুষের দায়ের করা হাইকোর্টের মামলা। ওই দিঘির এক বড় অংশ ভরাট করে নাকি পাতা হবে স্বপ্নের রেল লাইন। স্থানীয় মানুষের জীবনজীবিকার অপরিহার্য ওই দিঘিটি বাঁচিয়ে রেলপথ করলে মানুষ বাঁচবে কিন্তু স্বপ্ন হোঁচট খাবে। এর আগে ভরাট হয়েছে ডানকুনি জলা। প্রোমোটার-রাজের থাবায় আজ হাওড়ার সাঁতরাগাছি ঝিল ধ্বংসের মুখে। বিপন্ন পরিযায়ী পাখির বিচরণক্ষেত্র এই জলাভূমি। সাঁতরাগাছিতেই তো আস্ত একটা ঝিলকে সুচতুরভাবে গিলে খেয়েছে এক প্রোমোটার ও জমি হাঙর। এভাবেই রাজ্যের নানা প্রান্তে গত ৩০ বছর ধরে লাগাতার প্রথমে দূষিত করে পরে ভরাট করা হয়েছে একের পর এক জলা।
কলকাতায় এখন বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা ৫৫ শতাংশ। মুম্বই, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই শহরে সেই রাজ্যের যে মানুষ বাস করেন তাদের গড় প্রায় ৬৭ শতাংশ। তাই কলকাতার সংস্কৃতি ও ভোটের পাটিগণিত বদলে গেছে। এই শহরের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার দায় তাই ভূতের ঘাড়ে চাপতে চাইছে রাজনীতির কারবারিরা। আর এজন্যই জাতীয় পরিবেশ আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে কেএমডিএ এখন সুপ্রিম কোর্টে যেতে চাইছে।
রবীন্দ্র সরোবর বাঁচাতে বিভিন্ন পরিবেশ সংগঠন ও ব্যক্তিদের যৌথ উদ্যোগ ‘সবুজ মঞ্চ’ বহু দিন থেকেই আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই সরোবর দক্ষিণ কলকাতার ফুসফুস। এটি কখনই কোনও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের অঙ্গ ছিল না। কলকাতা হাইকোর্ট ও জাতীয় পরিবেশ আদালত রবীন্দ্র সরোবর ও তার সংলগ্ন সবুজ রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিয়েছে। ১৯১৭ সালের ১৫ নভেম্বর পরিবেশ আদালত এক নির্দেশে বলেছে ওই সরোবর ও আশপাশে কোনও পুজো, পিকনিক বা সামাজিক উৎসব কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। একই সঙ্গে কেএমডিএকে এই লেকের তত্বাবধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই নির্দেশ কার্যকর করতে কেএমডিএ-র সিইও ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর একটি জরুরি বৈঠক ডাকেন। সেই বৈঠকে ছিলেন মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলরস, কলকাতা পুলিশের পদস্থ আধিকারিক, বিহার নাগরিক সমাজ ও সবুজ মঞ্চ-সহ একাধিক পরিবেশ রক্ষা সংগঠন ও ব্যক্তি। বৈঠকে কেএমডিএ-র তরফে ঘোষণা করা হয় সরোবর রক্ষায় ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল (এনজিটি)-এর নির্দেশ যথাযথ ভাবে পালন করা হবে। সেই অনুযায়ী কেএমডিএ ছটপূজার জন্য তিনটি বিকল্প জলাশয় নির্ধারণ করে। ওই স্থানগুলির সংস্কারের জন্য অর্থের সংস্থানও হয়। এমনকী স্থানান্তরের জন্য পর্যাপ্ত পরিবহনের ব্যবস্থা করার কথাও বলা হয়। সমগ্র বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সকলকে জানানোর জন্য বাংলা ও হিন্দিতে লিফলেট ও পোস্টার তৈরি হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে কেএমডিএ একটি গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কিত রিপোর্ট পরিবেশ আদালতে জমা দেয়। সেখানে স্পষ্ট বলা হয় কোনও অবস্থাতেই রবীন্দ্র সরোবরে ছটপূজা করা যাবে না। উল্লেখ করা হয় বিকল্প ব্যবস্থাপনারও। এনজিটির নির্দেশ অমান্য করলে অভিযুক্ত হতে হবে এটাও সর্বতভাবে গ্রাহ্য বিষয় হিসেবে নির্ধারিত হয়ে আছে।
কিন্তু এসব সত্বেও গত বছর ছটপূজায় একদল দুষ্কৃতী পুলিশের সামনেই গেট ভেঙে সরোবরে ঢুকে পড়ে। যথেচ্ছ ভাবে জল দূষণ করে এবং রবীন্দ্র সরোবর এলাকাকে নোংরা করে ফেলা হয়। দূষণের ফলে মাছ মরে ভেসে ওঠার অভিযোগও ওঠে। এভাবেই যখন পরিবেশে আদালতের নির্দেশ অমান্য করার ঘটনা ঘটল তখনই দেখা গেল রাজনৈতিক নেতারা আদালতে জমা দেওয়া বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভুলে ওই তথাকথিত ছটভক্তদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন!
আর এবার কেএমডিএ স্বয়ং পরিবেশ আদালতে (এনজিটি) ছটপূজার অনুমতির জন্য আবেদন করে বসলেন। সেখানে ওই আবেদন বাতিল হতেই দূষণকারীদের সন্তুষ্ট করতে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালের আবেদনকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার কথাও ঘোষণা করা হল। শুধু তাই নয়, পুর ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেছেন ছটপূজার চাইতে সিগারেটের ধোঁয়ায় বেশি দূষণ হয়। যদিও পরিবেশ আন্দোলনের সাথে যুক্ত মানুষ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জলদূষণের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের কথা বলে মন্ত্রীর যুক্তি মানতে নারাজ। কিন্তু জলদূষণের তোয়াক্কা না করা ছটপন্থীরা মন্ত্রীর ঘোষণায় প্রবলভাবেই উৎসাহিত। নিন্দুকেরা বলছেন জয় শ্রীরাম বনাম ছটপূজা, ভোটের এই রসায়নে কপাল পুড়ছে পরিবেশের।
অন্যদিকে কেএমডিএ যখন সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে সরোবরে ছটপূজার জন্য দরবার করতে ব্যস্ত, তখন সবুজ মঞ্চ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়েছে। সেই চিঠিতে সরোবরের দূষণ বাঁচাতে প্রয়াত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে মমতার লড়াইকে মনে করিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন মঞ্চের সম্পাদক তথা রাজ্যের পরিবেশ আন্দোলনের বিশিষ্ট মুখ নব দত্ত।
রূপম চট্টোপাধ্যায় : বরিষ্ঠ সাংবাদিক ও পরিবেশকর্মী। মতামত ব্যক্তিগত।
ছবি ঋণ : ইন্টারনেট
Comments are closed.