সরকারি ঘোষণা সত্বেও আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারের পড়ুয়ারা সংরক্ষণ পেল না রাজ্যে!
রূপম চট্টোপাধ্যায়
কলেজে ভর্তি-প্রক্রিয়া শেষ হতে চলল। এখনও এই রাজ্যে আর্থিক দিক থেকে দুর্বল শ্রেণির পড়ুয়ারা সরকারের ঘোষিত ১০ শতাংশ সংরক্ষণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত রয়েই গেল। গত শিক্ষাবর্ষে রাজ্য সরকারের তরফে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্থান না থাকায় এ রাজ্যের আর্থিক সঙ্গতিহীন পড়ুয়ারা সংরক্ষণের সুযোগ পায়নি। ২০১৯ সালের ২ জুলাই রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ রাজ্যের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিকভাবে দুর্বল শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য ১০ শতাংশ আসন সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শিক্ষামন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রী সে কথা ঘোষণাও করে দিয়েছিলেন। সেই সিদ্ধান্তকে সোচ্চারে স্বাগত জানিয়েছিল কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি-সহ রাজ্যের গোটা বিরোধী শিবির। তাই আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত বহু পরিবার আশা করেছিলেন চলতি শিক্ষাবর্ষে তাদের ঘরের পড়ুয়ারা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে এই সংরক্ষণের সুবিধা পাবেন।
যেসব পরিবারের বার্ষিক রোজগার ৮ লাখ টাকার বেশি নয়, ৫ একরের বেশি কৃষিজমি নেই বা ১০০০ স্কোয়ার ফিটের বেশি বসত বাড়ি নেই তারা ইকনোমিক্যালি উইকার সেকশন (EWS) বা আর্থিক দিক থেকে দুর্বল বলে গণ্য হবেন। এই মর্মে সরকারি শংসাপত্র পেলেই সেই পরিবারের পড়ুয়া বা চাকুরিপ্রার্থীরা এই সংরক্ষণের আওতায় আসবে। কেন্দ্ৰীয় সরকার ১০৩তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ২০১৯-এর জানুয়ারিতে দেশের আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারগুলি যারা বর্তমান সংরক্ষণের সুবিধার বাইরে তাদের জন্য এই নতুন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। এই সংক্রান্ত সংশোধনী ২০১৯ সালের ৮ জানুয়ারি লোকসভায় পাসও হয়। পরদিনই রাজ্যসভায় এই সংশোধনী বিলটি অনুমোদিত হয়। ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি বিলটিতে স্বাক্ষর করেন।
এরপরই উচ্চশিক্ষায় EWS কোটায় ভর্তির বিষয়টি চালু করতে গত ১৬ অগস্ট ২০১৯ সালে ইউজিসি-র অতিরিক্ত সচিব ড. দেব স্বরূপ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। তার ভিত্তিতেই ২০১৯-‘২০ শিক্ষাবর্ষে দেশের সব কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই সংরক্ষণ চালু হয়। পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতী গত শিক্ষাবর্ষের মতো চলতি শিক্ষাবর্ষেও ১০ শতাংশ EWS কোটায় ভর্তি সংক্রান্ত ইউজিসির নির্দেশ লাগু করেছে। রাজ্যের সরকারি কলেজ লেডি ব্রাবোর্ন, বেথুন-সহ বহু কলেজের অধ্যক্ষরা জানিয়েছে তারা উচ্চশিক্ষা দফতরের লিখিত নির্দেশ পেলেই EWS কোটায় ভর্তির বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। কিন্তু রাজ্য মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরও কেন সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ রাজ্যের পড়ুয়ারা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষামহলের একাংশ।
এখনও পর্যন্ত উচ্চশিক্ষা দফতর এই সংক্রান্ত কোনও সরকারি নির্দেশ তথা জিও প্রকাশ করেনি তা স্বীকার করেছেন দফতরের ল অফিসার জয়ন্ত ঢালি। তবে কেন ইউজিসির স্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্বেও রাজ্যের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সংরক্ষণ চালু করা হল না তা নিয়ে কুলুপ এঁটেছেন মন্ত্রী থেকে আমলা সকলেই। মানবাধিকার সংগঠন ‘ফোরাম ফর সিভিল লিবার্টি’ এই সংরক্ষণ চালু না করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে ১৯৯৩ সালের “সংরক্ষণ সীমা ৫০ শতাংশ” অতিক্রম না করার নির্দেশকেই দায়ি করেছে। ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে তফসিলি জাতি, উপজাতি ও পিছিয়ে-পড়া সম্প্রদায়ের উচ্চশিক্ষা ও চাকরিতে ৪৫ শতাংশ সংরক্ষণ চালু আছে। তাই আর্থিকভাবে দুর্বল শ্রেণির জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণ এ রাজ্যে চালু করলে তা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিত সীমা পেরিয়ে যাবে। এই আইনি জটিলতায় বিষয়টি আটকে থাকলেও রাজনৈতিক স্বার্থে কেউ বিষয়টি খোলসা করতে রাজি নয়। ফলে সংবিধান সংশোধন ও সরকারি ঘোষণার পরেও এ রাজ্যের আর্থিক দিক থেকে দুর্বল পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের এই সংরক্ষণ অধরাই থেকে গেল। যদিও তামিলনাডু সরকার বিশেষ সামাজিক পরিস্থিতির কারণ দেখিয়ে ৫০ শতাংশের সীমা ছাপিয়ে এই সংরক্ষণ লাগু করেছে সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন নিয়ে। এই রাজ্য এখনও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। আইনি জটিলতা কাটানোর কোনও উদ্যোগও নেই।
Comments are closed.