মুঠোফোনেই ‘বোল্ড-আউট’ ডিভিডি ব্যবসা

তথাগত চ্যাটার্জি
“আসুন দাদা নিয়ে যান, একদম কারেন্ট বইয়ের কালেকশন মাত্র ৩০ টাকায়।” কথাগুলো আর বলেন না বেহালা ট্রামডিপো লাগোয়া ডিভিডি ব্যবসায়ী রাজু (নাম পরিবর্তিত)। বছর দশেক ধরে চুটিয়ে ব্যবসা করেছেন সিডি, ডিভিডি, এমপিথ্রি-সহ কম্পিউটার গেমসের। পিকে, পিকু থেকে ধুম কালেকশন সবই থরে থরে সাজানো থাকত রাজুর রাস্তার ডিভিডির দোকানে। রাজুর দোকান ঘেঁষেই সম্ভ্রান্ত ক্যাসেট ও সিডির দোকান হারমোনি। অফিস ফেরতা মানুষ পুরনো দোকানে ঢুঁ না মেরে আসা যাওয়ার পথে রাজুর দোকান থেকেই কিনে নিয়ে যান পছন্দের ডিভিডি। ক্যাসেট, ভিসিডি পরবর্তীযুগে পালে হাওয়া লেগেছিল ডিভিডির। পছন্দের গোটা চারেক ছবি একই ডিভিডিতে। “আরে দাদা, দোকান থেকে একটা সিনেমার দামই পড়ে দুশো টাকা। সেখানে পাঁচটা সিনেমার কম্বো প্যাক পঞ্চাশ টাকায়। কেন যাবেন অরিজিনাল কিনতে?” বছর ছয়েক আগেও দিব্যি কলার তুলে বলতেন রাজু।
রাজুর দোকানের মতোই রাস্তার অপর প্রান্তে বছর সাতেক ধরে একটানা ডিভিডির দোকান চালিয়ে এসেছেন সুকুমার (নাম পরিবর্তিত)। দোকানের বিশেষত্ব ছিল হলিউডের কয়েক দশকের হরর ছবির কালেকশন। ব্যবসায় ঝাঁপ ফেলেছেন বছর তিনেক আগে। ডিভিডি বিক্রির তাকের উপর বেচেন ধূপকাঠি, মোমবাতি, ঠাকুর দেবতার ছবি। “ওসব ব্যবসা এখন ডাউন। পেট চালাতে হবে তো নাকি!” খানিকটা আক্ষেপ, খানিকটা ঝাঁঝ মেশানো সুরে বলে ওঠেন সুকুমার।
রাজু, সুকুমারদের মতো সিডি-ডিভিডির ব্যবসা করে একটা সময় লাভের মুখ দেখেছেন শহর থেকে শহরতলির আরও প্রচুর মানুষ। রাস্তার দোকানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে দোকানের ‘অরিজিনাল’ ক্যাসেট-সিডির ব্যবসা। ‘পাইরেসি’ বদনাম ঘোচাতে অনেকেই জোর দিতেন ডিভিডির গুণগতমানের উপরেও। তবুও ব্যবসার জোয়ারে ভাঁটা পড়ল কেন? “সর্বনাশটা হয়েছে ওই স্মার্টফোন আসার পরেই”। উত্তর ছুড়ে দিলেন এক সময়ের পরিচিত ডিভিডি বিক্রেতা আসিফ। “রাতবিরেতে যখন ইচ্ছে সাইট খোলো, আর টপাটপ বই নামিয়ে দেখে নাও”।
মুঠোফোনের জেন-ওয়াই দুনিয়া এখন আর ডিভিডির উপর ভরসা করে থাকে না। হালের ওয়েব সিরিজ প্রেক্ষাগৃহে বাছাই করা দিনে সিনেমা রিলিজেও অনেকখানি ভাগ বসিয়েছে, এ-ও মানেন অনেকেই। নেটফ্লিক্স, হই-চইয়ের পর্দায় ছবি তৈরিতে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে তরুণ থেকে সব বয়সের পরিচালকদের। ছক ভাঙছেন হলি-বলি-টলির অভিনেতারাও। সেক্ষেত্রে হলে গিয়ে ছবি দেখায় ভাঁটার টান স্পষ্ট। হালফিলের ওয়েব সিরিজে উঠে আসছে একঝাঁক উঠতি মুখ। অপরদিকে বহুদিন পর সুযোগ পেয়ে অন্য প্ল্যাটফর্মে চুটিয়ে অভিনয় করছেন চেনা মুখেরা। ছক ভাঙার এই নতুন গণ্ডিই ব্যবসায় মন্দা এনেছে ডিভিডির ক্ষেত্রে।
ফোর-জি নেটে ইচ্ছেমতন ডাউনলোড করে মন ভরে দেখে নেওয়া যায় পছন্দের ওয়েব সিরিজ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কপিরাইটগত ঝুঁকির দিক থেকে যা ডিভিডি আকারে বিক্রি করা যায় না। এখানেই হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে রাজু, সুকুমারদের। পাইরেসির সঙ্গে পাল্লা না দিতে পেরে বছর কয়েক আগে পাততাড়ি গুটিয়েছে মিউজিক ওয়ার্ল্ডের মতো নামি ব্র্যান্ড। ব্যবসায় ধাক্কা খেয়ে বন্ধ হয়ে গেছে মোজারবিয়ারের মতো এককালের নামি সিডির প্রতিষ্ঠান। বেলাগাম পাইরেসির জমানায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে পুজোয় সুমন-নচিকেতা-রূপঙ্করদের অ্যালবামের দিন। অ্যালবাম রিলিজ হয় ইউটিউবে। তাও কালেভদ্রে। স্বর্ণযুগের এমপি-থ্রি বা শ্যামাসঙ্গীত বেচে যাওবা লাভের মুখ দেখা যেত, করোনাকালে তাও এখন বন্ধ। বাধ্য হয়েই তাই চাকতি বেচার ধান্দা ছেড়ে ধর্ম বেচায় মন দিতে হয়েছে বেহালা থেকে বারাকপুরের সুকুমারদের। ঈশ্বর যদি মুখ তুলে চান…
Comments are closed.