কিশোরকালের দুর্গাপুজো
ছোটবেলায় দুর্গাপুজোর স্মৃতি আজও নাড়া দেয় মনকে। পুজো আজ কেমন যেন কর্পোরেট হয়ে গেছে। কর্পোরেট কোম্পানিরাই মস্ত মস্ত স্টল দিয়ে পুজোর মেলাকে হত্যা করেছে। স্যুভেনিরের পাতায় পাতায় বিজ্ঞাপন। পুজো এখন গৌণ– কে বড়, কার প্রতিমা সেরা সেই প্রতিযোগিতাই এখন মুখ্য হয়েছে। সাথে সাথে বাবার হাত ধরে জুতো কিনতে যাওয়া বা ঠাকুমা-মা পুজোর সময় নাড়ু-মুড়কি তৈরি থেকে নিরামিষাশী তৈরির তোড়জোড় সবই আজ এখন অতীত। শুধুই কর্পোরেট কালচার। পুরনো পুজোর নস্ট্যালজিক তর্পণে বঙ্গপুতুলের রূপকার নাট্যকর্মী শুভ জোয়ারদার।
শুভ জোয়ারদার
আমার কিশোরকাল কেটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর কন্ট্রোল-কবলিত নিত্য দোল-দুর্গোৎসব আচরিত, ভাগীরথী তটবর্তী এক মফসসল জনপদে। আজ থেকে কমবেশি সাড়ে ৫০০ বছর আগে শ্রীচৈতন্যের যে সকল প্রত্যক্ষ শিষ্যরা তাঁরই নির্দেশে ‘গৃহস্থ’ হয়েছিলেন, এই গ্রাম সেই বৈষ্ণব সংস্কৃতির স্মৃতিধন্য শ্রীপাট খড়দহ। পরবর্তীকালে দেশভাগের পরে পূর্বপ্রান্তের রহড়া এর সাথে সংযুক্তিকরণে একটি পুরসভার অধীনস্থ হয়।
আমি বলছি পাঁচের দশকের কথা। গোটা গ্রামে হাই স্কুল দুটি। একটি ছেলেদের, অন্যটি মেয়েদের। একটি মাত্র বাড়িতে টেলিফোন। বীরেনবাবুর বাড়ি। তা-ও প্রধানশিক্ষক আর কংগ্রেসী নেতা হওয়ার সুবাদে। একটিমাত্র মোটরগাড়ি ডাক্তার বামাপদ ভট্টাচার্যের। তাঁর দাদু ছিলেন বিখ্যাত নট ও নাট্যকার ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ। দুর্গাপুজোর সংখ্যা দুটি। একটি সর্বজনীন, ‘কুঞ্জবাটি’তে। ছাড়া ছাড়া আর্টের ঠাকুর। অন্যটি পারিবারিক– ভট্টাচার্যের ‘ক্ষেত্রপাল’ বাড়িতে। সাবেকি ঢঙের একচালা প্রতিমা। মাথার চালচিত্র অর্ধগোলাকার নয়, ত্রিভূজাকার তিনটি মুকুটের মতো। মাতৃবাহন সিংহটি কিছুটা ঘোটকসদৃশ্য। আর একটি পুজো হত, রেললাইনের ওপারে রহড়ায়। সেটি সর্বজনীনও নয়, পারিবারিকও নয়, সন্ন্যাসীদের পুজো। লোকাচার ধর্মাচার সবকিছু ঠিকঠাক মেনে, রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনের।
পুজো মানে তো একটা অ্যাসোসিয়েশন, কিছু কাঙ্খিত পরিচিত বর্ণ আর গন্ধের ছোট্ট ছোট্ট কোলাজ, যা স্মৃতির ডানায় ভর করে মুহূর্তে আমাদের নিয়ে যায় অতীতের স্বপ্নিল স্টোররুমে। আমাদের কিশোরকালের পুজোর ছবির সঙ্গে সমকালীন উন্মার্গী কর্পোরেট পুজোর কোনও মিলমিশ নেই।
সে কালে প্রায় প্রতিটি পরিবারে ছিল একান্নবর্তী। মধ্যবিত্ত সেইসব সাংসারিক যাপনচিত্রগুলি ছিল বেশ কিছুটা পারিবারিক প্রধানের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রিত। আমাদের পরিবারও তার বাইরে ছিল না। বেশ মনে পড়ে, পারিবারিক নীতি-নির্ধারণ করতেন আমাদের ঠাকুরমা হেমাঙ্গিনী দেবী, আর বাবা জ্যাঠামশাই তা পালন করতেন। বর্ষার পরেই জিনিসপত্র রোদে দেওয়া আর ঝাড়াঝাড়ির মধ্যেই বুঝতাম পুজো আসন্ন। শিউলি-ছাতিমের সুবাস আর মেঘমুক্ত নীলাকাশেও এর সমর্থন থাকত।
আমরা কচিকাঁচার দল নতুন ছাঁটের জামাকাপড় আর জুতোর পরিকল্পনায় উদ্ধারণ কমিটির চেয়ারম্যান– অভিভাবকদের মন পেতে, তাদের আগেপিছে ঘুরঘুর করতাম। রেডিমেড পোশাকের প্রচলন থাকলেও সেখানে নির্দিষ্ট মানুষের জন্য নির্দিষ্ট জামাপ্যান্ট বানিয়ে নেওয়াই ছিল অভিজাত রুচি। এখনকার মতো ব্র্যান্ডের জামাকাপড়ের চল ছিল না। কাজেই আমরা ভাইবোনেরা প্রায় ইউনিফর্মের মতো একই ছাঁটের দরজিবাড়ি থেকে আসা জামাকাপড় পেতাম।
বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে দলবেঁধে বাবার সঙ্গে কলকাতায়। আর বাটা কোম্পানির সেই শ্লোগানটা অন্তত আমাদের জন্যে সত্যি ছিল : পুজোয় চাই নতুন জুতো! নতুন জুতোর বাক্স হাতে ঝুলিয়ে শ্লাঘামায় পদচারণায় আমরা বাড়িতে ঢুকতাম, সেটা ঐতিহাসিক কোনও সাম্রাজ্য বিজয়ের থেকে কম ছিল না। বাড়িতে মেয়েরাই সংখ্যাগুরু ছিল হলে সেখানেও ছিল সেকালের ফ্যাশন– ‘মানে না মানা’ বা ‘পথিক’ শাড়ি বা ‘হলিডে অন আইস’ স্কার্টের জনপ্রিয়তা।
ঠাকুমাকে দেখতাম সপ্তমীর ভোরে দরজার মাথায় নানাবিধ মাটির ফোঁটা দিতে। সধবা মায়েদের জন্য নিয়ম মেনে বাবা আনতেন আলতা-সিঁদুর-গন্ধ তেল-সাবানের বিশেষ প্যাকেজ। রান্নাঘরে কিছু বাসনপত্র আর আলাদা একটা উনুন ছিল নিরামিষাশী রান্নার জন্য। পুজোর আগে থেকেই নানা রকমের নাড়ু আর মুড়কি নির্মাণে ঠাকুমার খবরদারিতে সেখানে ব্যস্ততা চলত। আর ছিল পুজোর গান আর পূজাবার্ষিকী, যা প্রথমে কাড়াকাড়ি, শেষে ভাগাভাগি করে আস্বাদন করতাম আমরা।
আজও ঢাকিরা ঢাক বাজায়। তবে খালে-বিলে নয়, কংক্রিটের হর্মকাঠিন্যের চাতালে। সে মাটির দুলুনি আর পাই না। আমার মনে হয়, আজকের কর্পোরেট-কিশোররা আমাদের নাড়ুগন্ধী আর নতুন জুতো শিয়রে রেখে ঘুমোতে যাওয়ার মজাটাই হারিয়ে ফেলেছে?
ছবি ঋণ : ইন্টারনেট ও লেখক
Comments are closed.