ডা. সুকুমার হাঁসদা : বন্ধুবিয়োগের স্মৃতিচারণা – দ্বিতীয় পর্ব
ঝাড়গ্রামের ভূমিপুত্র ডা. সুকুমার হাঁসদা। বৃহস্পতিবার কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে প্রয়াত হন ঝাড়গ্রাম তথা জঙ্গলমহলের এই চিকিৎসক নেতা। বন্ধুবিয়োগের কারণে দীর্ঘ ৪০ বছরের বন্ধুত্বের ছেদে আজ মন ভালো নেই বন্ধুর। ভারাক্রান্ত মনে স্মৃতির সরণি বেয়ে বন্ধুকে স্মরণ অর্ক চৌধুরীর। আজ দ্বিতীয় পর্ব।
অর্ক চৌধুরী
তার কয়েক বছর বাদেই ঝাড়গ্রামের ঠিকানায় পোস্টিং। তখন আমার ঠিকানা রাজবাড়ি। অর্থাৎ রাজবাড়ি-অন্তর্গত একটা মেস্-এ। সেখানে আমাদের অভিভাবক ছিলেন স্বয়ং রানীমা! পুরাতন ঝাড়গ্রাম থেকে নতুন ঝাড়গ্রামের আমার অফিসের দূরত্ব প্রায় চার কিমি। সাইকেল-ই বাহন। ঝাড়গ্রাম মহকুমা হাসপাতালের ঠিক বিপরীতেই ডা. সুকুমার হাঁসদা-র বাড়ি। তার পাশেই আমার দফতরের একটা শাখা-অফিস তখন চালু ছিল ভাড়াবাড়িতে। হাসপাতালের উত্তর দিকের গেটের পাশেই এক প্রাচীন বনস্পতির (কুসুম গাছ) নীচে রঞ্জুদা’র চায়ের দোকান— কাজের অবসরে সরকারি ডাক্তারবাবুদের গলা ভেজানোর ঠিকানা। প্রবল গ্রীষ্মের প্রাক্-মুহূর্তে ঝাড়গ্রামের রঙ বদলায় দ্রুত গতিতে।
প্রকৃতির সেই নতুন-নতুন সাজবদলের অপরূপ খেলা প্রতিদিনই মনের রঙ বদল ঘটায় রোম্যান্টিক মানুষের। কুসুম গাছের পাতা ঝরে তখন যেন এক ‘সাজিয়াছ যোগী’! তার পরেই সেই বনস্পতির অপরূপ সাজবদলের শৌখিনতা। প্রথমে হালকা লাল রঙের রেশমি সাজ। দু’ দিন বাদেই সেই লাল গাঢ় হয়ে যেন তান্ত্রিকের প্রকাশ! তারপর ধীরে-ধীরে পাতার রঙবদল ধীর লয়ে। হালকা সবুজ। সবুজের মখমলের সাজের বাহার। তারপর কুসুমের গাঢ় সবুজের পোশাক।… রঞ্জুদা’র তেলেভাজার রঙ কখনও বদল হবেবনি হে রিপোর্টার…! দাও হে রঞ্জুদা, ডবল পেঁয়াজি আর বড় করে চা। ততক্ষণে হয়তো-বা আরও চারজন চিকিৎসকের আগমন। সুকুমার ডাক্তারের সূত্র ধরেই শহরের এক ডজন ডাক্তারের সঙ্গে পরিচয় মাত্রই দু’-সপ্তাহের মধ্যে। বন্ধুত্ব ও চায়ের দোকানের ভূষকালো নড়বড়ে চড়লা কাঠের বেঞ্চিতে বসেই। জানো হে ফোটোগ্রাফার… রঞ্জুদা’র তেলেভাজা বানানোর ওই যে-আলকাতরা রঙের কড়াইটা দেখছ… সেটার বয়স কত বলতে পারবে কি…? জেনে রেখো এই দোকানের জন্ম হয়েছিল পলাশির যুদ্ধের ঠিক তিন বছর আগে। আর রঞ্জুদা ওই কড়াইটা কিনেছিল দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধের সময়ে…! ওই যে-তেল… ডবল আলকাতরার রঙ… ভয় পাওয়ার কিছু নেই— সেই পুরাতন দিনে ওই তেলটা ছিল খাঁটি গব্য ঘৃত! জগৎ শেঠের বাথান থেকে কিনে এনে স্বয়ং মিরকাশিম রঞ্জুদাকে উপহার দিয়েছিলেন ওই পবিত্র তৈল…! পাশ থেকে ডা. মুখার্জি যোগ দিলেন… ওই কৃষ্ণবর্ণ তেলে ভাজা এই উপাদেয় পেঁয়াজি হজম করতে পারলে তুমি অবশ্য সিরাজদৌল্লা বনে যেতে পারবে না। তবে তোমার মনটা হয়ে উঠবে শাহজাহান বাদশাহ্-র মতো ফুরফুরে। দু’টো খেলে মেজাজ সাফা। আর চারটে খেলে তিন ঘণ্টার মধ্যেই পেট সাফা। তবে কোনও ডাক্তার কিন্তু প্রেসক্রিপশনে এ-সব রেমেডি লিখবেন না। কারণ রঞ্জুদার এই অয়েল কেক রেমেডি, ডাক্তারি সিলেবাসে নেই। ফেলুদাপ্রেমী ডা. হাঁসদা বেশ গম্ভীর গলায় বলে উঠল— ‘নাও এবার কালটিভেট করে দ্যাখো! ঝাড়গাঁয়ের ডাক্তারবাবুদের অভিজ্ঞতার স্যাচুরেশন ডেনসিটি।’
হাসপাতাল গেটের ওই কুসুম গাছটার বয়স কখনও কেউ মেপে দেখেনি। রঞ্জুদা’র দোকানে ডাক্তারবাবুদের এই আড্ডার বয়স কত সেটাও কেউ মেপে দেখেনি। হাসপাতালে এখন অনেকগুলো বড়-বড় গেট হয়েছে মেন রোডের দিকে। কিন্ত এই দক্ষিণ গেটের গুরুত্ব বোধহয় কমেনি। রঞ্জুদা’র দোকান আজও আছে। তবে সম্ভবত ডাক্তারবাবুদের সেই আড্ডাটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ২০১১-য় সুকুমার মন্ত্রী হওয়ার পর-ই। মনে হয় সিকিউরিটির কড়াকড়ির কারণে। আমি ২০১২-তে আবার ঝাড়গ্রামের অফিসে ফিরে গিয়ে সে-র’ম জমাট আড্ডা আর দেখিনি। কয়েকজন ডাক্তারবাবু আসতেন। হঠাৎ আমাকে দেখে এসেওছিলেন জনাচারেক চিকিৎসক। কিন্তু বেশিক্ষণ বসেননি। হয়তো সুকুমারের অনুপস্থিতির কারণে। তা ছাড়া ওই দীর্ঘ দশ বছরের মধ্যে অনেক ডাক্তার বদলি হয়ে চলে গিয়েছিলেন অন্যত্র। সুকুমার ততদিনে সরকারি চাকরি ছেড়ে সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দিয়ে বিধায়ক হয়েছিল। স্থানীয় ভাবে ওর জনপ্রিয়তা ছিল প্রচুর, তাই প্রথমবার ২০১১-র নির্বাচনী লড়াইয়ের ময়দানে ও জিতে গিয়েছিল অনায়াসে। কিন্তু ২০১৬-র নির্বাচনে সুকুমার জয়ী হলেও লড়াইয়ে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। হয়তো ততদিনে ওর জনপ্রিয়তা কমেছিল (?)! হয়তো ক্ষমতার ঘেরাটোপ ওকে গড় জনতার আঙিনা থেকে সরিয়ে নিয়েছিল কিছুটা।
ঝাড়গ্রাম হাসপাতাল এখন ‘সুপার স্পেশালিটি’ হয়েছে। আগে ছিল মহকুমা হাসপাতাল। এখন হয়েছে জেলা সদর হাসপাতাল। হয়তো সেখানে চিকিৎসকের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত হাসপাতালে চিকিৎসা করা, এমনকী মাঝরাতেও জেগে-থাকা ডাক্তার এখন আর আছে কিনা আমার জানা হয়ে ওঠেনি। তখনও ঝাড়গ্রামের ওই হাসপাতালে ডাক্তারবাবুদের সংখ্যা ছিল অনেক। প্র্যাকটিসিং অ্যান্ড নন-প্র্যাকটিসিং ডক্টরও ছিলেন অনেক। বলা চলে সেখানে প্রায় সব ডাক্তারই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতেন। কিন্তু দু’জন ডাক্তারকে আমি কখনোই প্রাইভেট চেম্বারে বসে চিকিৎসা করতে দেখিনি। প্রথমজন ডা. সুভাষ হাজরা এবং দ্বিতীয়জন অবশ্যই ডা. সুকুমার হাঁসদা। রঞ্জুদা’র দোকানে বসে সুকুমার সবে চায়ে চুমুক দিয়েছে, কোনও রোগী এসে হয়তো বলল— ডাক্তারবাবু, এসেছি। সুকুমার এক ঝলক তাকিয়ে বুঝে নিত পেশেন্টের আর্থিক অবস্থা কেমন। বলত— হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে যান, আমি আসছি। রোগী পরীক্ষা করে প্রেসক্রাইব করে হাসপাতাল থেকেই ওষুধের বন্দোবস্ত করে দিত। হাসপাতালের স্টোরে ওষুধ অমিল হলে তা কিনে দিত রোগীকে। তার অনুরোধে আমরাও মাঝে-মাঝেই গ্রাম থেকে আসা দুঃস্থ রোগীদের ওষুধ কিনে দিতাম। আমাদের সবার রক্তের গ্রুপ ওর মুখস্থ ছিল।
কারও হঠাৎ রক্তের প্রয়োজন হলে সুকুমার সিধে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে যেত। সে-সময়ে টেলিফোনের এই স্বর্ণযুগ ছিল না। কাজেই হঠাৎ-করে কাউকে প্রয়োজন হলে, তাকে খুঁজে বেড়াতে হত। আগেই বলেছি রাতবিরেতে জরুরি ভিত্তিতে কারও ডাক্তারের প্রয়োজন হলে তখন সুকুমার ডাক্তার ভরসা। প্রবল শীতের রাতেও লেপ ছেড়ে ডা. হাঁসদা হাজির হত হাসপাতালে। বেশ মনে পড়ে, ফরেস্ট রেঞ্জার পিন্টুদাকে যে-বার ডাকাতরা (জঙ্গল মাফিয়া) তির মেরে জখম করেছিল… হাসপাতালে আনার পরে পিন্টুদার অতি জরুরি অপারেশনের বন্দোবস্ত করেছিল ডা. সুকুমার হাঁসদা। ভয়ানক ঝুঁকি নিয়ে সেদিন ওই অপারেশন না-করলে পিন্টুদাকে বাঁচানো দুষ্কর ছিল।
(চলবে)
অর্ক চৌধুরী : বিজ্ঞানকর্মী।। বন্যপ্রাণ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
ছবি ঋণ : ইন্টারনেট
Comments are closed.