‘তৃণমূলই তৃণমূলের শত্রু’, মানছেন দলের নেতারাই
অযোগ্য লোকেদের দায়িত্ব দেওয়া এবং যে সমস্ত নেতৃত্ব জনগণের কাছে চক্ষুশূল তাঁদেরকে সামনের সারির নেতৃত্বে আনার ফলে সমূহ ক্ষতি হয়েছে তৃণমূলের। নেত্রীর কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছচ্ছে না। যার ফলে সর্বনাশ ঘনিয়ে আসছে। অন্তর্তদন্তে সাংবাদিক বীরেন ভট্টাচার্য।

বীরেন ভট্টাচার্য, নয়াদিল্লি
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি বিজেপির প্রচার কমিটির প্রধান হলেও তিনি যে প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন তা এক প্রকার স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেবারে ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে দেশে ব্যাপক ভাবে পাপড়ি মেলেছিল পদ্মফুল, তার সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘদিন পর বাংলার মাটিতে বিকশিত হয়েছে শতদল। পাঁচ বছর পর ২০১৯ সালে সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ১৮টি আসন পায় তারা। সেইসঙ্গে দেশব্যাপী নিজেদের আসন সংখ্যা ৩০০-র গণ্ডি পার করে। অন্যদিকে তৃণমূলের আসন সংখ্যা ৩৪ থেকে কমে হয় ২২।
লোকসভা নির্বাচনের ঠিক দু’বছর পর অর্থাৎ ২০২১ সালে বিধানসভা ভোট পশ্চিমবঙ্গে। ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তৃণমূলের কাছে ক্ষমতা ধরে রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তার কারণ, দিন যত গড়িয়েছে দলের নেতাদের বিরুদ্ধে তোলাবাজি, দাদাগিরি থেকে শুরু করে মানুষের থেকে দূরে সরে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গ্রামাঞ্চলগুলিতে প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের হাড়ি না চাপলেও বহাল তবিয়তে থেকে ক্ষমতার মধু পান করে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে শাসকদলের নেতা-মন্ত্রী-জনপ্রতিনিধিরা। আর একে মোটেই ভাল ভাবে দেখছেন না সাধারণ মানুষ। মানুষের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের প্রতি বিভিন্ন কারণে তৈরি হয়েছে অসন্তোষ। উঠেছে তোষণের রাজনীতির অভিযোগও। আর তাকে কাজে লাগিয়েই হিন্দু ভোটে থাবা বসাতে প্রস্তুত গেরুয়া বাহিনী। তৃণমূলের এক নেতা হলফ করে বলতে পারলেন না ২০২১-এ বিধানসভা নির্বাচনে বাংলায় আবারও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়-জয়কার হবে। বরং উল্টো কথাই শোনা গেল ঘাসফুল শিবিরের ওই নেতার কথায়।
তাঁর মতে, অযোগ্য লোকেদের দায়িত্ব দেওয়া এবং যে সমস্ত নেতৃত্ব জনগণের কাছে চক্ষুশূল তাঁদেরকে সামনের সারির নেতৃত্বে আনার ফলে সমূহ ক্ষতি হয়েছে দলের। একইসঙ্গে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রশান্ত কিশোরের দল তৃণমূলের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ বলেও মনে করেন তিনি। তৃণমূলের ওই নেতা আশঙ্কা প্রকাশ করে জানান, দলের নেতা-সাংসদ-বিধায়কদের যোগ্যতার মাপকাঠিতে বিচার না করে তাবেদারির নিক্তি ধারায় মাপা হয়েছে। আর সেই কারণেই বিপাকে পড়েছে দল। মমতা শিবিরের ওই নেতা জানান, বিজেপির এ রাজ্যে শক্তিবৃদ্ধির মূল কারণ প্রধানত তিনটি :
১. তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, যার মূল কারণ তোলাবাজি;
২. কংগ্রেস এবং সিপিএম-এর সঙ্গে তৃণমূলের বিমাতৃসুলভ আচরণের ফলে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত ঘটেছে তাদের মদতেই;
৩. দলের যে সমস্ত নেতারা সামনের সারিতে রয়েছেন তাঁরা দলনেত্রীকে সব বিষয়ে সঠিক তথ্য দিচ্ছেন না অর্থাৎ নেত্রীর কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছচ্ছে না। যার ফলে সর্বনাশ ঘনিয়ে আসছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই তৃণমূল নেতা জানান, যেসব যুবনেতাদের দলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মানুষের কাছে তাঁদের প্রতিচ্ছবি ভালো নয়; বিশেষ করে যুব তৃণমূল কংগ্রেস থেকে মূল সংগঠনে আসা নেতাদের। ফলে তৃণমূলই হয়ে উঠেছে তৃণমূলের শত্রু! বিজেপির সংগঠন থাকলেও তাঁদের যোগ্য নেতা বা মুখ না থাকার কারণে পদ্মের চারায় সার যোগাচ্ছে বিক্ষুব্ধ তৃণমূল, সিপিএম এবং কংগ্রেস। অন্যদিকে জনমানুষের পশ্চিমবঙ্গে প্রশাসনিক শক্তিবৃদ্ধি সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখছে না। প্রশাসনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা নেতৃত্ব বা উন্নয়নমূলক কাজ নিজেদের মতো করে করতে পারছেন না দলের নেতা ও অনেক জনপ্রতিনিধিই। আর এই কারণে ২০২১-এ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ফল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা এখন বলা খুব শক্ত।
জেলাভিত্তিক সংগঠনের কতগুলি দিক তুলে ধরেন দলের এই নেতা। যেমন:
হাওড়া : অরূপ রায় এবং রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো রাজনৈতিক এবং কর্মঠ ব্যক্তিকে সরিয়ে অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব লক্ষ্মীরতন শুক্লাকে নেতৃত্বে আনায় দলের সংগঠনের ক্ষতি হয়।
হুগলি : তপন দাশগুপ্তর মতো সাংগঠনিক লোককে সরিয়ে দিয়ে দলের নেতৃত্বে সাংসদ-বিধায়ক আনা ভালো চোখে দেখছে না সাধারণ মানুষ।
বর্ধমান পূর্ব : তৃণমূলের ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বর্ধমান জেলার এই আসনটি সবেধন নীলমণি। পরপর দু’বার আসনটি ধরে রেখে দলের মুখরক্ষা করেছেন সুনীল মণ্ডল। ফলে এহেন মানুষের সাংগঠনিক ক্ষমতা বা জনমানুষে গ্রহণযোগ্যতার কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। পাশাপাশি তাঁর ব্যবহারে আপ্লুত এলাকার মানুষ। দলের বিধায়ক নেতাদের একাংশের বিরোধিতা সত্ত্বেও নিজে দাঁড়িয়ে আসনটিতে জয়ের ধারা অব্যাহত রেখে তিনি তাঁর রাজনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
নদিয়া : একক ভাবে মহুয়া মৈত্রকে দায়িত্ব দেওয়া এবং শংকর সিং, উজ্জ্বল বিশ্বাস, গৌরী দত্তর মতো নেতাদের সরানোর ফল ভুগতে হবে ঘাসফুল শিবিরকে।
উত্তর ২৪পরগনা : এই জেলায় তৃণমূলের সাংগঠনিক পরিস্থিতি একেবারে তলানিতে। বেশিরভাগ নেতা-কর্মী-সমর্থকরাই উপরে তৃণমূল হলেও ভিতরে গেরুয়া। বাস্তবিক পরিস্থিতি কী তা সময়ে প্রমাণ মিলবে।
দক্ষিণ ২৪পরগনা: এই জেলায় নেতৃত্বে লড়াই শোভনীয় নয় মোটেই। নেতৃত্বের লড়াই বা গোষ্ঠী কোন্দল যথেষ্ট বেগ দেবে ঘাসফুল শিবিরকে।
পূর্ব মেদিনীপুর : অধিকারী পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের রসায়ন বা কোন্দলের জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা বলা শক্ত।
বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া ও পশ্চিম বর্ধমান : এই সমস্ত জেলাগুলিতে মূল শক্তি তৃণমূল এবং বিজেপি। যোগ্য লোক না থাকার কারণে নির্বাচনে এই জেলাগুলিতে দলের ভরাডুবি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
বীরভূম : অনুব্রত মণ্ডলের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে দলের নেতাদের বিদ্রোহ ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে। বিভিন্ন ছোট ছোট ঘটনায় তার প্রমাণ মিলেছে। ফলে শেষমেষ ভোট বাক্সে কী ফল হবে তা এখনই বলা শক্ত।
মুর্শিদাবাদ : এই জেলাতেও পরিস্থিতি আগেরগুলোর মতোই, কংগ্রেসের অধীর রঞ্জন চৌধুরীর শক্তি খর্ব করতে পারে এমন যোগ্য নেতার অভাব রয়েছে তৃণমূলে।
মালদা-সহ উত্তরবঙ্গ : যোগ্য নেতাদের বসিয়ে যুবনেতাদের সামনে আনা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত দলের ভালো হবে বলা যায় না। বিশেষ করে এসসি/এসটি/ওবিসি সম্প্রদায়ের মধ্যে যোগ্য নেতার অভাব রয়েছে। যাঁদের নেতৃত্বে আনা হয়েছে তাঁদের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক দক্ষতা অনেক কম। এসসি/এসটি/ওবিসিদের ওপর জুলুমবাজি এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে তোলাবাজির জন্য দলের সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা। সঙ্গে এসসি-এসটি উন্নয়ন পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার ফলে দলের ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না। এসসি/এসটি/ওবিসি সম্প্রদায়ের মধ্যে যোগ্য নেতার অভাব দলের ক্ষতি করবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই তৃণমূল নেতা জানান, এখনও সময় রয়েছে। যোগ্যতার নিক্তি ধারায় এবং এসসি/এসটি/ওবিসি সম্প্রদায়ের মধ্যে দক্ষ নেতাকে দায়িত্ব দিলে পরিস্থিতি কতটা পাল্টাবে তা বলা যাবে না, তবে দল যে ভরাড়ুবির হাত থেকে বাঁচবে সেটা বলা যায়।
ছবি ঋণ : ইন্টারনেট
Comments are closed.