Bengal Fast
বিশ্ব মাঝে বাংলা খবর

অভাজনের অমূল্যায়ন : ভরতের নাট্যশাস্ত্র নিয়ে সহজিয়া বাউল

চন্দন সেন

করোনার চাপে বার্ধক্যের পাপে আমার একমাত্র অহংকারী যোগ্যতা, মানে নাটক লেখা কিংবা নাট্যচর্চা নিয়ে ভাবতে বা কলম ধরতে যখন মাঝেমধ্যেই হাত কাঁপে তখন ৭৫-অতিক্রান্ত এক চিরকিশোর বাউল আমার কাছে একেবারে সহজ বাংলায় লেখা ভরতের নাট্যশাস্ত্র (আট অধ্যায় নিয়ে প্রথম খণ্ড) পাঠিয়ে দিল। ছাপ্পান্ন বছর আগে বছর-কুড়ির এক প্রেমিকাবেষ্টিত ছাত্রনেতা তার অসাধারণ অ্যাকাডেমিক যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে মাঝেমধ্যেই হাতে তার মোটা বইগুলোর মধ্যে নিয়মিত দু’-একটাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরত। তার মধ্যে সংস্কৃতে প্রচুর নম্বর পাওয়ার পুরস্কার হিসেবে আমাদের সংস্কৃত স্যারের উপহার দেওয়া ভরতের নাট্যশাস্ত্রও থাকত। উরেব্বাবা, কী বৃহৎ বই, কী জটিল বিন্যাস, সেই দেবভাষা পাঠ ও অনুধাবনে আসুরিক ধৈর্য ও স্থৈর্য নিয়ে এগুতে হচ্ছিল, কারণ তখনও নাটক বা থিয়েটার আমার ব্যক্তিজীবনের দখল নেয়নি।

ড. শুভ জোয়ারদার

যাদবপুরে সান্ধ্য ক্লাসে অধ্যাপিকা প্রণতি দে’র ক্লাস শেষ-করে-আসা এক সহপাঠিনীকে শেক্সপিয়ারের নাটকের সূত্রে আমি ভরতের নাট্যশাস্ত্র থেকে গড়গড় করে কয়েক লাইন সগর্বে শুনিয়ে তাকে এবং এইট-বি বাসস্ট্যান্ডে জড়ো হওয়া অন্যদের খুব ইমপ্রেস করেছিলাম মনে আছে। (কী হাস্যকর ছিল সেই বিদ্যে জাহির!) বহু বছর পর এই মহাভারত-সদৃশ গ্রন্থের দু’টি খণ্ডিত বাংলা অনুবাদ হাতে আসে, একটি কলকাতায়, অন্যটি ঢাকায়— বলা বাহুল্য, তখন বয়স বছর-চল্লিশ স্পর্শ করেছে। সহিংস কৃষক আন্দোলন করে জমি দখলের অভিজ্ঞতা-স্পর্ধিত প্রথম যৌবনের এবং অন্তত বার-পাঁচেক জেলখানায় ঢোকার হ্যাংওভার পুরো কাটাতে তখনও পারিনি। তাই এই তৎসম শব্দবহুল কবি অমিয় চক্রবর্তীর প্রিয়চর্চাস্পর্শিত কঠিন বাংলার মতো দুর্গম দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা বঙ্গানুবাদ পড়ে দু’বারই হিংস্র হতে ইচ্ছে করছিল। বরং ইংরেজি অনুবাদটি (বন্ধুর বাড়িতে) দেখে ও সামান্য পড়ে ভালো লাগছিল।

- Sponsored -

শেক্সপিয়ারের নাটকের কিছু মুদ্রিত বঙ্গানুবাদ দুই বাংলায় পড়েও এমনই জিঘাংসা বহুবার জেগেছে আমার। এমন সব নাতিসুখকর অভিজ্ঞতা নিয়ে আর এতকাল পর এমন ভয়ঙ্কর ভাইরাসের ভয়ে গৃহবন্দি হয়ে থাকতে-থাকতে ড. শুভ জোয়ারদারের সহজতম বাংলায় লেখা মাত্র ১২৮ পৃষ্ঠার সুরম্য বইটি হাতে পেলাম। বৃদ্ধা স্ত্রীর সঙ্গে প্রাত্যহিক আলাপ ও বিবাদ শেষ করে পড়ার ঘরে বসে প্রতিকূল ঘর ও বাহিরের পরিবেশে যখন আমি বিরক্ত, তখন শুভ-র অনুবাদে— ‘কি উপায়ে নাট্যবেদ রচেন প্রজাপতি/ তত্ত্ব প্রয়োগ কেমন করে ক অঙ্গে তার গতি’ (নাটকের উৎপত্তি, উদ্দেশ্য, উৎস ইত্যাদি) পড়ে চলেছি! শেষ করতে যখন বিকেল নামল, তখন আমার সামনে শুভর আশ্চর্য বঙ্গভাষে ৩৬ প্রকার দৃষ্টি— রসদৃষ্টি (৮), স্থায়ী দৃষ্টি(৮) এবং অবশিষ্ট দৃষ্টি (২০)-র পাঠ সম্পূর্ণ। পরে বোনাস হিসেবে পাওয়া দু’টি অসাধারণ নিবন্ধ— একটি ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর নিবন্ধ ‘ভরতের নাট্যশাস্ত্র’, এবং দ্বিতীয়টি অশোকনাথ শাস্ত্রীর লেখা ‘নাট্যশালার গোড়ার কথা’।

এতদিন এই বই শুভ লেখেনি কেন? বইটি শেষ করে শুভ-র উদ্দেশে স্বগত কটূক্তি বর্ষণ করতে-করতে যখন এ-কথা ভাবছিলাম জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, তখন সন্ধ্যার অন্ধকার চাদর বিছিয়ে জোনাকিদের ডেকে এনেছে। পাঠ-শেষে নিজেকে বললাম, এমন তন্বী সুদর্শনা গ্রন্থিত ভাবনাপ্রতিমার কোনও রিভিউ হবে না, বিমুগ্ধ ভিউ শুধু হতে পারে। নামী পত্রিকার নামী মিডিয়ার স্পেসে (এক সময়ে তো লিখেছি, যথেষ্ট নগদ মূল্য পেয়েছি) নাম দেখতে এখন বিরক্তি মেশানো বিষাদ আসে! সমাজপতিদের সমর্থনে বিরোধিতাসর্বস্ব লেখায় ভর্তি, মহাপরাক্রমশালীদের নগদ মূল্যে কেনা হুকুমদারির ছবি ও বক্তব্য-নিয়ন্ত্রিত ‘নিরপেক্ষ’ মিডিয়ার চতুর্থ পৃষ্ঠার পঞ্চম কলামের দীন প্রান্তে পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যুর সংবাদের পাশেও শুভ জোয়ারদারের এই অমূল্য বইটির খবর দেখা যায়নি। যাবেও না। তার বদলে মহার্ঘ্য স্পেসে চিত্রতারকার আদর করে ল্যাপটপকে চুমু খাওয়ার দৃশ্য বা আনুষঙ্গিক প্রায় কুড়িটি অবশ্যপাঠ্য লাইন অনিবার্য ভাবেই দৃশ্যমান। সমাজনিয়ন্ত্রক বাবুদের সহাস্য ছবি আর তার তলায় পরিযায়ী শ্রমিকদের রেললাইনে কাটা পড়ার ছয়লাইনি বিষাদ!

এই সুনিয়ন্ত্রিত ‘নিরপেক্ষতা’য় একটি অন্য ধরণের পত্রিকার তরফে এই পুরনো মানুষটার কাছে যখন তাগাদা এল, শুভ-র ‘ভরতের নাট্যশাস্ত্র’ নামক চমৎকার প্রচ্ছদে, ততোধিক চমৎকার রূপান্তরে আমার ভরতের নাট্যবিদ্যার আদি শাস্ত্রজ্ঞানে প্রথম খণ্ডটিকে নিয়ে লেখার, তখন ভাবলাম ‘সুখী গৃহকোণ, শোভে গ্রামোফোন’ (এইচএমভি-র সেই বিজ্ঞাপনী ভাষা) হয়ে ঘরে বসে-বসে এত্ত নাটক লেখা হল, এত রূপান্তর, অনুবাদ এতগুলো বই এবং ইত্যাদি পড়া হল অথচ আমার যে-বন্ধুটি বাণিজ্যে স্নাতকোত্তর হয়েও জীবনে বাণিজ্য শিখল না, ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা-র স্নাতক হয়েও সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার স্কুলে পড়ল না, কেন্দ্রীয় হিসাব দফতরের দায়িত্ব সামলেও বেহিসেবি মনের খাদ্যের নেশায় ঘুরে বেড়াল দেশ-বিদেশের গ্রামে-গ্রামান্তরে, হতাশ যৌবনে মানুষ যে-সময়ে নিশ্চুপ নির্জীব পুতুল হয়ে যাচ্ছে তখন পুতুলকে নিয়ে নতুন মানবিক নাট্য তৈরি করল, সে এখন আবার সহজে কেরিয়ার তৈরিতে বিশ্বাসী অশিক্ষিত কিন্তু প্রচারে প্রতারিত নাট্যকর্ম ছেড়ে পিঠে হাত দিয়ে ভরতের নাট্যশাস্ত্র এগিয়ে দিয়ে বলছে— দাদা ধরা-র আগে এই বইটা ধরো! নিজেকে অভিনয়ে শিক্ষিত করার প্রথম পাঠ এই বই। ভিতরের যোগ্যতাকে জ্ঞানের চাকু দিয়ে আর নাট্যশাস্ত্রের বিজ্ঞান দিয়ে নির্মেদ করে নাও, ব্যস্, বাকিটা সময়ের হাতে! তাই এই বইটিকে আজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অবশ্যপাঠ্য ঘোষণা করতে চাইছে ৭৬ বছরের এই ক্লান্ত নাটককার। অসংখ্য বাজে কিন্তু দারুণ জনপ্রিয় নাটকের মধ্যে দু’-একখানা ভালো নাটক লেখার স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে এখনও সেই নামী নাটককার, হাস্যকর ভাবে! শুভ, জয় হোক তোমার, আর জয় হোক নাট্যবিষয়ক অনিবার্য এবং আশ্চর্য এই বইটির।

________________________

ভরতের নাট্যশাস্ত্র।। ড. শুভ জোয়ারদার।। পরিবেশক : অক্ষর প্রকাশনী, ১৮এ ট্যামার লেন, কলকাতা ৭০০ ০০৯।। মূল্য ২০০ টাকা

Subscribe to our Whatsapp Group for daily news alerts.


You might also like

- sponsored -

Comments are closed.