যোগীর রামরাজ্যেই লাঞ্ছিত ‘বাল্মীকি’, এ এক অন্য রামায়ণ
বীরেন ভট্টাচার্য, নয়াদিল্লি
প্রথম মূল রামায়ণ লিখেছিলেন মহর্ষি বাল্মীকি। সেই বাল্মীকি সম্প্রদায়ের এক যুবতীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া অমানবিক অত্যাচার এবং খুন, তারপর পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে ঘরে-বাইরে প্রবল সমালোচনার মুখে উত্তরপ্রদেশের সন্ন্যাসী রাজা যোগী আদিত্যনাথ। শনিবার রাতে তিনি অবশ্য সিবিআই তদন্তের সুপারিশ করেছেন। তবে প্রশ্ন সেখানে নয়! প্রশ্ন উঠেছে, সরযূ নদীর তীরে অযোধ্যায় গগনচুম্বি রামমন্দির তৈরি করে যে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন গেরুয়া শিবিরের ম্যানেজাররা, হাতরাসের ঘটনা কোথাও যেন সেই রামরাজ্যে রাবণের দর্পিত পদচারণ খুঁজে পাচ্ছে রাজনীতি ও সমাজনীতিবিদরা।
হাতরাসে নির্যাতিতা যুবতী ছিলেন বাল্মীকি সম্প্রদায়ের। এই সমাজটি ভারতে দলিত হিসেবে পরিগণিত। উত্তরপ্রদেশের মোট দলিত সম্প্রদায় রয়েছে ২২ শতাংশ, তার মধ্যে ৫-৬ শতাংশ এই বাল্মীকি সম্প্রদায়ের। বাকিদের মধ্যে রয়েছে কোরি, হরিজন-সহ বিভিন্ন দলিত সম্প্রদায়। উত্তরপ্রদেশে বাল্মীকি সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা ৭০ হাজার ৮৯৪ জন। এছাড়াও অন্যান্য দলিত সমাজ তো রয়েছেই।
উত্তরপ্রদেশে সামাজিক থেকে শুরু করে রাজনীতি– সব কিছুতেই আধিপত্য ব্রাহ্মণ, ঠাকুর এবং রাজপুত সম্প্রদায়দের। তার মূল কারণ হিসেবে মনে করা হয়, আর্থ-সামাজিক বিন্যাস। কারণ দেখা গিয়েছে, উত্তরপ্রদেশের বেশিরভাগ জমি রয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ ঠাকুর সম্প্রদায়ের হাতে। ফলে ‘জমি যার, ক্ষমতা তার’ এই ফর্মূলায় দেশের বৃহত্তম রাজ্যটিতে ঠাকুর সম্প্রদায়ের হাতে ক্ষমতা রয়েছে। যদিও ‘তিলক তরাজু অউর তলোয়ার, মারো ইনকো জুতো চার’, স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এসে কাশীরামের উত্তরসূরি মায়াবতী দলিতসমাজের অনেকটাই ক্ষমতায়ণ করেছেন।
উত্তরপ্রদেশে সরকারি চাকরিতে দলিত বা তপশিলি জাতিদের জন্যে সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের হার ২২ শতাংশ, অন্যদিকে ওবিসি বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য এই হার ২৭ শতাংশ। ফলে দলিতসমাজের কিছুটা ক্ষমতায়ণ হলেও সামাজিক অস্পৃশ্যতা এখনও দূর হয়নি, সে বিজেপির ম্যানেজাররা যতই দলিতদের বাড়িতে খাবর খান বা রাত কাটান! সামাজিক সাম্যই মূলকথা, সেদিক থেকে দলিতসমাজ এখনও ‘দলিত’ হয়েই রয়ে গিয়েছে। তার জ্বলন্ত উদাহরণ সম্প্রতি হাতরাসের ঘটনা। সেখানে পুলিশ দলিত পরিবারটিকে জানিয়েছে তাঁরা যেহেতু ইংরেজি পড়তে পারেন না, সেইজন্য ময়না তদন্তের রিপোর্ট তাঁদের নেওয়ার প্ৰয়োজন নেই, কারণ সেটাই তো ইংরাজিতে লেখা। অর্থাৎ এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়েই সেখানকার দলিতসমাজের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে যায়। তবে ভোটব্যাঙ্কের রসায়নের কথা মাথায় রেখে তাদের কিন্তু ব্যবহার করতে দ্বিধা করে না রাজনৈতিক দলগুলি, সম্প্রতি বিজেপিও।
১৯৯১ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত হাতরাস লোকসভা আসনটি ধরে রেখেছিল বিজেপি। ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনে সেখানে জয় পায় রাষ্ট্রীয় লোকদল। আবার ২০১৪ সালে তপশিলি জাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসনটিতে পদ্মফুল ফোটে। সেই ধারা জারি থাকে ২০১৯-এও। সেখানকার বর্তমান বিজেপি সাংসদ রাজভীর সিং দিলের ৫৯.৪৯ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছেন। তিনিও দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত, যদিও নিজ সম্প্রদায়ের এক কন্যার ওপর ঘটে যাওয়া অনামবিক অত্যাচার এবং পরিবারের ওপর পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে তাঁকে নড়াচড়া করতে দেখা গেল না!
এই বাল্মীকি সম্প্রদায়ের মানুষরা উত্তরপ্রদেশে সংখ্যায় অনেক কম, এবং অস্পৃশ্যতার শিকার। যাঁদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রামায়ণের রচয়িতার অতীত, তাঁরা রামরাজ্যে কেন এত অবহেলিত বা বঞ্চিত তার কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
সব শেষে একটা কথা বলার, ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে মহিলাদের স্বনির্ভর করে তুলতে এবং নারীশিক্ষার হার বাড়াতে ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ স্লোগান তুলেছিল বিজেপি। এখন প্রশ্ন বেটি যদি নাই বাঁচে, তাহলে তাঁকে পড়ানো হবে কীভাবে? এ-তো কিছুটা ‘কাঁঠালের আমসত্ত্ব’ ধরনের তত্ত্ব। অন্যদিকে রামরাজত্ব বলতে সাধারণ ভাবে কিন্তু অযোধ্যার রাজপরিবারের ধনুর্ধর সুপুরুষ রামচন্দ্রের রাজত্বকাল বোঝায় না। রামরাজত্বের সার্থকতা নারী নিরাপত্তা, মহিলাদের ক্ষমতায়ণ, সবার সমান অধিকার অর্থাৎ সামাজিক সাম্যর মতো বিষয়গুলি। সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে কংক্রিটে রামমন্দির তৈরি হলে সেখানে অহংকার, ক্ষমতার দম্ভ থাকবে, রামচন্দ্র থাকবেন না। যদি সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা যায়, নারী নির্যাতনে রাশ টানা যায় তাহলেই সরযূ নদীর তীরে তৈরি হবে একবিংশ শতকের রামায়ণ।
Comments are closed.