মুসলিম নারীর অধিকারের কথা
সিরিন সারওয়ার
পিএইচডি গবেষিকা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়
পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও নারীর প্রতি বৈষম্য নারীর অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে সব থেকে বড় বাধা। নারী পুরুষের অধীন, কারণ ঈশ্বরই নারীকে অবলা সৃষ্টি করেছেন– পুরুষতান্ত্রিকতার এই ছলনা থেকে মুক্তি পেলেই নারীর প্রতি একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। নারীর অধিকার রক্ষার আন্দোলন বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক। নারীর প্রতি নির্যাতন ও নারীর অধিকার হনন কোনও জাতপাত বা ধর্মীয় বিশেষে হয় না, নারী মাত্রই নির্যাতনের শিকার হন। ‘নারী’ নামের এই অর্ধেক আকাশটি সর্বদাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অর্ধেক আকাশের ছায়াতলে নিহিত থাকে। তবে বিশেষভাবে মুসলিম নারীর অধিকারের কথা বলতে গেলে তাকে এই অর্ধেক আকাশের এক টুকরো মেঘের সাথে তুলনা করলেও চলে। রোশেনারা খানের লিখিত ‘বাঙালি মুসলিম সমাজ ও নারী’ বইটি ঠিক তারই নিদর্শন আমাদের সামনে তুলে ধরেছে।
এই বইটিতে একাধারে বাঙালি মুসলিম সমাজের সামাজিক রীতিনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, পোশাক-আশাক, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রাসঙ্গিকতা যেমন রয়েছে তেমনি বাঙালি মুসলিম নারীর মর্মবেদনা এবং তাদের অবস্থানের উল্লেখ রয়েছে। এই বইটি মূলত ১১টি অধ্যায়ের সংকলনে লেখা হয়েছে। যেখানে লেখিকার নিজস্ব অভিজ্ঞতার চিত্রও প্রস্ফুটিত হয়েছে। লেখিকা তাঁর জীবনযাত্রা থেকে দেখিয়েছেন একজন সাধারণ নারীর অসাধারণ চিত্তে পৌঁছানোর কাহিনি। উল্লেখিত বইটিতে রোশেনারা খান মহাশয়ার একদিকে বাল্যবিবাহ, অন্যদিকে উচ্চশিক্ষার গণ্ডি না ছুঁয়েও একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ সুপ্রতিষ্ঠিত লেখিকা এবং সমাজ সংস্কারক হয়ে ওঠার কথা প্রত্যেকটি অধ্যায়ে প্রস্ফুটিত হয়েছে।
লেখিকা এখানে নিজেকে বাঙালি মুসলিম নারীর প্রতিভূ হিসেবে সামনে রেখে মুসলিম সমাজের সামাজিক রীতিনীতি এবং আধুনিক যুগের সাথে পরিবর্তনের ধারায় নারীর অবস্থান কোথায়, তা-ই তুলে ধরেছেন। প্রথম অধ্যায়টিতে যেমন লেখিকার নিজস্ব জীবনব্যাপী কাহিনিস্বরূপ তার শৈশব কাল থেকে বাল্যবিবাহিত নববধূ রূপে নিজর পরিচয় হারিয়ে ফেলা এবং পরবর্তীকালে কবিতা ও গল্প লেখার মাধ্যমে নিজেকে খুঁজে পাওয়া ও স্ব-প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বার্তা পাওয়া যায়। তেমনই দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ে মুসলিম সমাজের বাল্যবিবাহ, পুরুষের একাধিক বিয়ের অধিকার ও পণপ্রথার মতো বিষয়গুলোর প্রতি লেখিকার আক্রমণাত্মক মনোভাবের পরিচয়ও পাওয়া যায়। যদিও এখানে তিনি দেখিয়েছেন মুসলিম পুরুষের একাধিক বিয়ের মাত্রা পূর্বের তুলনায় কমেছে তবুও “একজন স্ত্রীর মনের মধ্যে এই (স্বামীর একাধিক বিয়ের অধিকার) ভয়টা সবসময়ই থাকে, স্ত্রীকে অনুগত রাখার এটা একটা অস্ত্র। একজন অস্ত্রধারী মানুষের সঙ্গে একজন নিরস্ত্র মানুষের প্রেম ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কি সম্ভব? আবার বহুবিবাহের এই অধিকার পুরুষকে তালাকের ক্ষেত্রেও বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছে”।
পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম অধ্যায়ে বাঙালি মুসলমানদের বৈবাহিক রীতিনীতি, মহিলাদের জীবন-জীবিকা ও পোশাক-আশাক সংক্রান্ত তথ্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়। অষ্টম অধ্যায়ে লেখিকা আমাদের সামনে তিন তালাকের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। মুসলিম শরীয়ত অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্বামীর দ্বারা দেওয়া তালাকের দুটো ভাগ থাকে, ‘তালাক-এ-সুন্নত’ এবং ‘তালাক-এ-বিদ্দৎ’ (তিন তালাক) । প্রথম ভাগটি শরীয়তের ঐতিহ্যগত নিয়ম অনুযায়ী হয়। কিন্তু দ্বিতীয় ভাগটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে বলিয়ান করার খাতিরে সমাজের নবপ্রবর্তিত নিয়ম রূপে সামনে এসেছিল। উল্লিখিত অধ্যায়ে এই বিষয়ে সবিস্তারে আলোচনা হয়েছে। যদিও ২১টি মুসলিম প্রধান দেশে এই তিন তালাক প্রথাকে বাতিল করা হয়েছে এবং ভারতবর্ষেও ২০১৯ সালে পার্লামেন্টে ও সুপ্রিম কোর্টে এই তিন তালাক প্রথাকে বাতিল করেছে। বর্তমানে তিন তালাক একটি দণ্ডনীয় অপরাধ যার জন্য স্বামীর ৩ বছরের কারাদণ্ডও নিশ্চিত হতে পারে। সরকারের এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপ মুসলিম নারীকে তার অধিকার প্রাপ্যের ক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে দিয়েছে।
নবম অধ্যায়ে নারী পাচার এবং দশম অধ্যায়ে নারী শিক্ষার মতো বিষয় রয়েছে। যেখানে নবাব ফয়জুন্নেসা থেকে শুরু করে বেগম রোকেয়া প্রমুখের মতো মুসলিম নারীর শিক্ষার বিস্তারে উল্লেখ্যনীয় ভূমিকার উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও শেষ অধ্যায়টিতে মুসলিম মহিলাদের অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রাসঙ্গিকতা বা ইউনিফর্ম সিভিল কোডের উল্লেখ করেছেন। যাতে মুসলিম মহিলাদের সম্পত্তির অধিকার, বিবাহের অধিকার, বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, কর্মসংস্থানের অধিকারের ক্ষেত্রে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়।
রোশেনারা খানের লেখা ‘বাঙালি মুসলিম সমাজ ও নারী’ বইটি মুসলিম নারীদের বর্তমান অবস্থা বোঝানোর ক্ষেত্রে এবং তাদেরকে তাদের প্রাপ্য অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে একটি প্রাসঙ্গিকতা প্রদান করেছে। মুসলিম মহিলাদের রাজনৈতিক দল বা ধর্মীয় গোষ্ঠী ব্যতিরেকে মহিলাদের সংগঠনের মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে সংস্কারে এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়াও আমার মনে হয়েছে নারীরূপী তৃতীয় লিঙ্গ বৃহন্নলাদের কথা এখানে সংযুক্ত হলে ভালো হত। তবে এই পিছিয়ে-পড়া বাঙালি মুসলিম নারীগোষ্ঠীর মর্মবেদনা আমাদের সামনে তুলে ধরার জন্য লেখিকার পাশাপাশি ‘সহজপাঠ’ প্রকাশনাও অনেক ধন্যবাদের প্রাপ্য।
বাঙালি মুসলিম সমাজ ও নারী, রোশেনারা খান, সহজপাঠ, হাওড়া-৭১১১১১, ২০১৭, মূল্য ২০০
Comments are closed.