ডা. সুকুমার হাঁসদা : বন্ধুবিয়োগের স্মৃতিচারণা
ঝাড়গ্রামের ভূমিপুত্র ডা. সুকুমার হাঁসদা। আজ কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে প্রয়াত হন ঝাড়গ্রাম তথা জঙ্গলমহলের এই চিকিৎসক নেতা। বন্ধুবিয়োগের কারণে দীর্ঘ ৪০ বছরের বন্ধুত্বের ছেদে আজ মন ভালো নেই বন্ধুর। ভারাক্রান্ত মনে স্মৃতির সরণি বেয়ে বন্ধুকে স্মরণ অর্ক চৌধুরীর। আজ প্রথম পর্ব।
অর্ক চৌধুরী
ঝাড়গ্রাম থেকে দূরে আছি দীর্ঘ দুই দশক। এই কুড়ি বছরে ঝাড়গ্রাম অনেকটাই বদলেছে। প্রায় বিলুপ্তির পথে ঝাড়গ্রামের আশেপাশের শাল জঙ্গলের ঘনত্ব। ইতিমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন ঝাড়গ্রামে আমার পরিচিত বহু মানুষ। ইদানীং ঝাড়গ্রামে গেলে শুধুই মৃত্যুসংবাদ পাই। আগেই চলে গিয়েছিল চুনী কোটাল। সেই ১৯৯০ দশকে। তারপরে বিজন ষড়ঙ্গী, ২০০৭-এ। এ-রকম অনেক বন্ধুই চলে গেছে। ৪০ বছর আগের আমাদের খুব কাছের সামাজিক সংস্কারবদ্ধতার মুখগুলি একে-একে হারিয়ে অতীতে পর্যবসিত হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। যেমন কয়েক মাস আগে চলে গেছে আমাদের খুব কাছের মানুষ হপন মাঝি। এ-রকম প্রায় ডজন-তিনেক লড়াকু মানুষের মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছি বিগত কুড়ি বছরে।
আজ বেলার দিকে খবর এল বন্ধু ডা. সুকুমার হাঁসদা চলে গেল। সুকুমার আমাদের খুব কাছের মানুষ ছিল সেই ১৯৮০-র দশক থেকে। সেই হারিয়ে যাওয়া দশকে যখন আমরা ছিলাম টগবগে যৌবনের পথিক। এখন সকলেই বার্ধক্যে। বলা চলে মৃত্যুর পথেই এখন আমাদের পদচারণা। তবু কেউ চলে গেলে, কারও চলে যাওয়ার খবর পেলে বুকের ভিতরটা নিজের অজান্তেই মুচড়ে ওঠে বইকী! ভুলতে পারি কই, চার দশক আগের সেই অতি পরিচিত লড়াকু বন্ধুদেরকে?
কয়েক মাস আগে হঠাৎ-ই একদিন খবর পেয়েছিলাম বন্ধু হপন মাঝির চলে যাওয়ার খবর। কয়েক বছর আগে চলে গেছে বন্ধু ডা. পতি। সজল মাঝি, পাঁচু হাঁসদা, সম্বরি মুর্মু, এমনকী স্নেহাস্পদ বাবলু মুর্মু এবং ঘাটশিলার বোস’দা-র মৃত্যুর খবর আজও মন থেকে মুছে যায়নি। স্মৃতি থেকে আজও হারিয়ে যায়নি সেই পরিচিত মুখগুলো। ১৯৯৭-তে চলে গিয়েছিলেন ঝাড়গ্রামের রানীমা। তার পরে নরেন হাঁসদা।
আমি ঝাড়গ্রাম ছেড়েছিলাম ২০০০ সালে। তারপর সুবর্ণরেখা আর কাঁসাই দিয়ে বহু কোটি গ্যালন জল গড়িয়ে গেছে। এখন আমরা কেউ আছি, কেউ নেই। সময়ের বিসর্পিল গতি কাকে রাখে, কাকে যে দূরে সরিয়ে দেয়! কয়েকদিন আগের খবর— কবিবন্ধু বিমান মাহাতো প্রয়াত! আমাদের সেই চলমান ‘অরণ্যের কবি’ ভবতোষদা আর ‘রাঙামাটির যুগলপ্রসাদ’ ললিত বেরা এবং ডা. ললিত পাহাড়ির চলে-যাওয়ার খবর এখনও অম্লান স্মৃতিতে। স্বীকার করতেই হয়, স্মৃতি বড় বেদনার।
১৯৮০-র দশকে আমি ঝাড়গ্রামের মাটিতে পৌঁছনোর কয়েকদিনের মধ্যেই যে-দু’জন মানুষের সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিল (আমার অফিস সার্কেলের বাইরের বন্ধু), ডা. সুকুমার হাঁসদা তাঁদের অন্যতম। ঝাড়গ্রামের আরণ্যক ভূবলয়ে যে আমাকে চাকরি করতে যেতে হবে, তা সেখানে পৌঁছনোর আগে কখনও ভাবিনি। তার আগে দু’বার নেহাত বেড়াতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল ডা. সুকুমার হাঁসদার সঙ্গে। নেহাতই পথের আলাপ ১৯৭০-এর দশকের শেষ বছরে শিলদার হাটতলায়! ক্যামেরা-চোখে আনমনে ছবি করছিলাম হাটের জনতার। পিছন থেকে কে এসে মৃদু ধাক্কা দিয়ে আমাকে পথের পাশে ঠেলে দিয়েছিল…! ক্যামেরার ভারী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ভারসাম্য বজায় না-রাখতে পেরে পড়ে গিয়েছিলাম নরম ভিজে লাল মাটিতে। চকিতে দেখেছিলাম একটা কেঁদো ষাঁড় বেশ জোরে হেঁটে চলে যাচ্ছে আমার গা ঘেঁষে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড! পথচলতি গ্রামের মানুষ আমাকে টেনে তুলেছিল ভূমিশয্যা থেকে। সংকীর্ণ রাস্তার অপর দিকের মোরাম-বাফারে তখনও ভূমিশয্যায় কাত হয়ে শুয়ে, উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল ডাক্তার হাঁসদা। ছুটে গিয়ে হাত বাড়িয়ে তাঁকে উঠতে সাহায্য করলাম। ভূমিশয্যা ছেড়ে উঠে সুকুমার বলেছিল— এই তো হাতে হাত! চোখে চোখ। দু’জনেই ভূমিশয্যায়… হয়ে গেল বন্ধুত্ব। হ্যাঁ, সেই ছিল বন্ধুত্বের শুরু। লালমাটিয়া বন্ধু ছিল সুকুমার। ধাক্কাধাক্কিতে ওর স্টেথোটা হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার-মানুষ। স্টেথো-বিনা বড় অসহায়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেই স্টেথো ফিরে এসেছিল হপন মাঝির হাত ধরে। সেই ছিল শুরু…!
সে-বারের যাত্রায় বেড়ানো হয়েছিল বেলপাহাড়ি পার হয়ে ভুলাভেদা আর তামাজুরি পর্যন্ত। জঙ্গলে ভাল্লুক আর একজোড়া সজারু দেখেছিলাম। না, প্রথম দর্শনে দলমার হাতিদের দেখা মেলেনি সে-বার। শিলদা গেলে আমরা তখন আড্ডা দিতাম বাঁকুড়া রোডের বাঁ দিকের একটা ছোট চেম্বারে। ডা. হপন মাঝির চেম্বার। কিছু দূরে চায়ের দোকান। আর তার পাশেই তেলেভাজা আর জিলিপির ঠিকানা। উল্টো দিকে ফুটপাতের ধারেই ভাস্কর নবরতন কর্মকারের স্টুডিয়ো।
(চলবে)
অর্ক চৌধুরী : বিজ্ঞানকর্মী।। বণ্যপ্রাণ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
ছবি ঋণ : ইন্টারনেট
Comments are closed.