Bengal Fast
বিশ্ব মাঝে বাংলা খবর

আমার শৈশবের দুর্গাপুজো

দুর্গাপুজোয় ধর্মীয় সম্প্রীতির নজির যুগ যুগ ধরে বহমান। হিন্দুদের পুজো-পার্বণে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুসলিমদের সহযোগিতা করার রেওয়াজ সর্বজনবিদিত। আসলে মানুষের গড়া বিভেদের প্রাচীর ভেঙে ফেলার ডাক দুর্গাপুজো। স্মৃতিপটে ছোটবেলার দুর্গাপুজোর আখ্যান তুলে ধরলেন সমাজকর্মী রোশেনারা খান।

রোশেনারা খান

আমাদের শৈশব-কৈশোরে, মানে ৬০/৭০-এর দশকে দুর্গাপুজো ছিল অফুরান আনন্দের উৎস। আমাদের গ্রাম মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর প্রতিমা গড়া হত মঙ্গলামাড়াতেই। অনেক আগেই কাঠামোয় মাটি চাপানো হত। ঠাকুর গড়তেন গ্রামের দুর্লভকাকা। বাবাকে সাহায্য করত তাঁর বড়ছেলে লক্ষ্মীদা। ৭-৮ খানা গ্রামের মধ্যে আমাদের গ্রামেই দুর্গাপুজো হত। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে বইখাতা রেখেই ছুটতাম ঠাকুরগড়া দেখতে। মঙ্গলামাড়ার সামনের আটচালায় বসে ওই মাটি নিয়েই পুতুল বানাতাম। আমার বন্ধু প্রীতির বড়দি দীপ্তিদি খুব সুন্দর পুতুল বানাতে পারতেন। আমাদের বানিয়েও দিতেন। রথের মেলার পর থেকেই মায়ের খালি হিমালয় পাউডারের কৌটো ফুটো করে পয়সা জমাতে শুরু করতাম পুজোর সময় মেলা দেখার জন্য। সপ্তমী থেকে দশমী মঙ্গলামাড়ার সামনে মেলা বসত। দিনে মেলা আর রাতে আটচালায় অনুষ্ঠিত হত যাত্রাপালা। এই যাত্রাপালাই ছিল ছেলে-বুড়ো সবার কাছে দুর্গাপুজোর মূল আকর্ষণ। মাঝে-মাঝে তরজা গানও হত।

মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ি

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা থানা বহুকাল পূর্বে বগড়ি রাজ্য ছিল। অনেকে মনে করেন বকডিহি থেকে বগড়ি নামের উৎপত্তি। জনশ্রুতি মহাভারতের বকরাক্ষসের রাজ্য ছিল ‘বকডিহি’। ১৭২০ খ্রিস্টাব্দে শামসের সিংহ বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাকে পরাজিত করে বগড়ি অধিকার করেন। এইসময়ই তিনি তাঁর রাজধানী গড়বেতা থেকে ৮ মাইল দূরে মঙ্গলাপোতা গ্রামে স্থানান্তরিত করেন। অনেকে বলে থাকেন এই স্থানের নাম মঙ্গলাপোতা হয়েছে শামসের সিংহ তাঁর রাজধানী এখানে স্থানান্তরিত করার সময় উনি গড়বেতার সর্বমঙ্গলা মন্দির থেকে মঙ্গলঘটটি তুলে নিয়ে এসে এই স্থানে পুঁতেছিলেন বলে। তা থেকেই এই গ্রামের নাম হয় মঙ্গলাপোতা। তাঁর সময় থেকেই আমাদের গ্রামে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে।

মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর প্রতিমা

৪-৫ দশক পূর্বে গ্রামাঞ্চলে বারোয়ারি পুজোর চল ছিল না। সেইসময় মঙ্গলাপোতার রাজবাড়ি ছাড়া আশেপাশে কোথাও দুর্গাপুজো হত না। গড়বেতায় সর্বমঙ্গলার মন্দির থাকায় ওখানেও দুর্গাপুজো হত না। তখন শহরাঞ্চলেও দুর্গাপুজো উপলক্ষে পোশাক, জুতো, প্রসাধন সামগ্রী, নকল গহনার এমন ব্যাপক হারে বিজ্ঞাপন দেখা বা শোনা যেত না। আমরা দেখতাম চোখজুড়নো, মনভোলানো প্রাকৃতিক বিজ্ঞাপন। নীল আকাশ, সাদা মেঘ, শিশিরমাখা শিউলি, টগর। বাতাসে শিউলির গন্ধতেই পেতাম পুজোর গন্ধ। টলটলে দিঘি ও পুকুরের জল ছেয়ে থাকত পদ্ম-শালুকে। আর শিলাবতী নদীর দুই পাড়জুড়ে সাদা কাশফুল যেন কেতন উড়িয়ে জানান দিত, পুজো আসছে, পুজো আসছে।

- Sponsored -

বাঙালির দুর্গাপুজো যতটা না ধর্মীয় উৎসব ছিল, তারচেয়ে অনেক বেশি সামাজিক উৎসব। এই পুজো হিন্দু-মুসলিম, ধনী-দরিদ্র সবার কাছেই সমান আনন্দের ছিল। তখন গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। বিশেষ করে এই ভাদ্র-আশ্বিনে। খেটে খাওয়া দিনমজুর পরিবারের ক্ষমতা ছিল না ছেলেমেয়েদের বছরে একবারের বেশি নতুন জামাকাপড় কিনে দেওয়ার। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব পরিবারের ছেলেমেয়েদের দুর্গাপুজোর সময়ই নতুন জামা হত। শুধু আমাদের গ্রামে নয়, আশপাশের সব গ্রামেই হিন্দু-মুসলিম সবার বাড়িতেই মেয়ে-জামাই, আত্মীয়স্বজন আসবে বলে ঘরদোর পরিষ্কার করা, ধার-উধার করে হলেও তাদের আদর আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে রাখা, পুজোর আগেই এই প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। চারিদেকে পুজো পুজো গন্ধ আর সাজো সাজো রব শোনা যেত।

শিলাবতী নদীর পাড়জুড়ে কাশফুল

চারদিন যে যাত্রাপালা হত, তার মধ্যে তিনদিন বাইরের দল। একদিন গ্রামের মানুষেরাই অভিনয় করতেন। রাজপরিবারের লোক ছাড়াও লায়েক, মাঝি, এমনকী আমার জ্ঞাতি কাকা-দাদারাও অভিনয় করতেন। রোজ সন্ধেবেলা রাজাদের কাছারি বাড়িতে যাত্রার মহড়া চলত। মাঝিপাড়ায় চলত কাঠিনাচের মহড়া। ডোমপাড়ায় মেথরা ডোমের বাবা ঢাকে বোল তুলত। দূর থেকে ভেসে আসা এইসব সুর কিছুতেই পড়ায় মন বসতে দিত না। পঞ্চমীর আগেই দুর্লভকাকা প্রতিমা সাজিয়ে ফেলতেন। গ্রামে ঠাকুর গড়ার কাজ খুবই কম হত। তাই দুর্লভকাকা ঘরামির কাজ করতেন। খুবই অভাবের সংসার ছিল। সংসারের অভাব মেটাতে সারাবছর কাকিমা ঢেঁকিতে চিড়েকুটে বিক্রি করতেন। তবুও ছেলেমেয়েদের দু’বেলা পেটভরে খেতে দিতে পারতেন না। পারতেন না তাদের বই-খাতার অভাব মেটাতে। এই দৈনদশার মধ্যেই ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে আমাদের ‘মঙ্গলাপোতা উচ্চ বহুমুখী বিদ্যালয়’ থেকে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় কাকার বড়ছেলে আমাদের লক্ষ্মীদা, লক্ষ্মীনারায়ণ শীল পশ্চিমবঙ্গে প্রথম স্থান অধিকার করে রাতারাতি আমাদের গ্রামের স্কুলকে বিখ্যাত করে তুলে ছিল।

মনে পড়ে যায় ঢাকির পিছু পিছু যাওয়া

ষষ্ঠীর দিন থেকেই মেলা বসতে শুরু করত। সপ্তমীর দিন নদীতে কলাবউ স্নান করাতে যাওয়ার সময় ঢাকির পেছনে আমরা ছোটরাও যেতাম। মেলায় বেশিরভাগ দোকান পাশের গ্রাম খড়কুশমার বাজার থেকে আসত। আমাদের বাড়ি থেকে মেলার দূরত্ব কয়েক মিটার মাত্র। রাস্তার পাশে বাড়ি, তাই বাড়িতে বসেই দেখতাম মহিলারা নতুন শাড়ি-গয়না পরে অষ্টমীর দিন পুজো দিতে চলেছেন। কচিকাঁচা, ছেলেবুড়োও চলেছে কেউ মেলা দেখতে, কেউ ঠাকুর প্রণাম করতে। আমরা তো বারবার যেতাম। মাঝিদের ছেলেরা ব্লাউজ ও ঘাগরার মতো করে শাড়ি পরে মেলায় ঘুরে ঘুরে কাঠিনাচ দেখাত। দূরের গ্রাম থেকে সাঁওতাল মেয়ে-মরদরাও নাচতে আসত। মেয়েরা লালপাড় সাদা শাড়ি পরত সায়া-ব্লাউজ ছাড়া। গলায় রূপোর হাঁসুলি ও বাঁকিচুড়ি পরত। খোঁপায় গোঁজা থাকত রূপোর পান কাঁটা। পুরুষরা ধুতি পরত। ধামসা-মাদলের তালে তালে মেয়েরা একে অপরের কোমর জড়িয়ে গান গেয়ে মেলায় নাচ দেখাত। আমাদের বাড়ির সামনেও নাচত। কী অপূর্ব সেই নাচ! যখন খুবই ছোট ছিলাম মেলার দুই প্রান্তে বাঁশের উঁচু মাচাতে নহবত বাজত। মেলায় নাগরদোলা আসত। সন্ধ্যা থেকে বসত জুয়াখেলা। ভাড়া করে আনা যাত্রাদলকে এদের থেকে টাকা নিয়ে দেওয়া হত। হ্যাজাক জ্বেলে আটচালায় বসত যাত্রার আসর। আমরা মিউজিসিয়ানদের ঠিক পিছনে বসতাম। রাজবাড়ির ও অন্যান্য মহিলারা বসতেন মঙ্গলামাড়ার দাওয়া ও পৈঠাতে। চাকুরিসূত্রে বাইরে থাকা কাকা-কাকিমারা এলে রাজবাড়ি থেকে তাঁদের বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানো হত। কাকারাও আসরে বসে যাত্রা শুনতেন।

কৈলাসে মহাদেবকে পার্বতীর আগমন বার্তা দেবে নীলকণ্ঠ পাখি। এখন নীলকণ্ঠ পাখি ধরা বা কেনা-বেচা বেআইনি।

আগে তোপদেগে নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে বিজয়া হত। বিজয়ার দিন প্রতিমার পা ধরে নাড়িয়ে রেখে শুধু ঘট বিসর্জন দেওয়া হত। সবচেয়ে ভাল যাত্রাপালাটি এইদিন অনুষ্ঠিত হত। পরদিন বিছানায় শুয়ে শুয়েই শুনতে পেতাম বিসর্জনের বাজনা। মন খারাপ হয়ে যেত। স্কুল খুললেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা…

 

ছবি ঋণ : ইন্টারনেট ও লেখিকা

Subscribe to our Whatsapp Group for daily news alerts.


You might also like

- sponsored -

Comments are closed.