জঙ্গলমহলকে অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড় করিয়েছে লকডাউন
ভিনরাজ্যে খাটতে যাওয়া শ্রমিকরা শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে পেশা বদলের কথা ভাবছে। যাঁরা অন্যের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করত, মুড়ি ভাজত, উঠোন-খামার গোবর দিয়ে নিকনোর কাজ করত, তাঁরা কাজ হারিয়েছে। ‘পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু বিদ্যাপীঠ’-এর ৪২৩ জন ছাত্রছাত্রীর আজ পড়াশোনা শিকেয় উঠেছে। অনলাইনে পড়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের মোবাইল ফোন নেই, তারা ফোনের ব্যবহারও জানে না। জঙ্গলমহলের এক জীবনযন্ত্রণার ছবি তুলে ধরেছেন সমাজকর্মী রোশেনারা খান।
রোশেনারা খান
‘কিরে বুধনা? কী করচিস?’ বুধনা একমনে বাখারি বানাচ্ছিল। মদনার কথা শুনে বলল– ‘এই যে কাকা ঝুড়া বুনব বলে বাখারি চাঁচচি।’ –’তুই ইসব কাজ শিকলি কবে?’ –’আগে সিকিনাই গো, প্যাটের জ্বালাই সিকচি বটে।’ বুধনা একা নয়, ভিন রাজ্যের কাজ থেকে গ্রামে ফিরে জঙ্গলমহলের বহু আদিবাসী শ্রমিকদের এই একই হাল।
১৮০০ শতকে ব্রিটিশরা এই বনাঞ্চলটির নাম দিয়েছিল ‘জঙ্গলমহল’। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই নামটির প্রচলন ছিল না। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর এই অঞ্চলটির উন্নয়নের জন্য বেশকিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার কিছু ব্লককে ‘জঙ্গলমহল’ নামে অভিহিত করে।
এই জঙ্গলমহল বা এই বনাঞ্চল চিরকালই শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত। যখন থেকে ‘দিকু’ (বহিরাগত)-দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, দেশিও মহাজনরা সরলতার সুযোগ নিয়ে প্রথমে তাঁদের ঠকিয়েছে। তারপর ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে ভিড়ে চালিয়েছে শোষণ-পীড়ন-নির্যাতন। কিছুটা সময়য়ের দাবি মেনে, কিছুটা সরকারি উদ্যোগে কিছু উন্নতি হলেও আজও বেশিরভাগ প্রান্তিক এলাকার মানুষগুলির জীবন অসহনীয় দারিদ্রতা ও বঞ্চনার মোড়কে মোড়া।
কোভিড-১৯ ও তার কারণে লকডাউন, মানুষের জীবনে যে পরিবর্তন এনেছে, তা খুবই অসুবিধাজনক ও কষ্টদায়ক। এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলের মানুষ কী পরিমাণ দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে তা তাদের মতো ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবে।
জঙ্গলের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষরা একটা সময় পর্যন্ত জঙ্গলের ওপরেই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল। জঙ্গলের কাঠ-পাতা, ফল-মূল, জন্তু-জানোয়ারই ছিল তাদের জীবনধারণের রসদ। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছুই বদলেছে। জঙ্গল এখন আর ওদের নয়। পশু শিকার, গাছ কাটার অধিকার অনেক আগেই হারিয়েছে। কিন্তু বন্ধ হয়নি শোষণ। অতি কষ্টে সংগ্রহ কেন্দুপাতা, শালপাতা মহাজনরা বলতে গেলে জলের দরেই কিনে নিয়ে যায়। এই পাতা সংগ্রহ করতে গিয়ে হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারাতেও হয়। তবুও জীবনে গতি এসেছিল। শহর-ঘেঁষা এলাকায় রাস্তা হয়েছে, সজলধারার জল পাওয়া যাচ্ছে, স্কুল হয়েছে, মরদরা ভিনরাজ্য থেকে বেশি টাকা রোজগার করে আনছে, বার্ধক্যভাতা ও রেশনে পর্যাপ্ত চাল দিচ্ছে। কিন্তু কোভিড-১৯ ও লকডাউনের ফলে, ভিনরাজ্যে খাটতে যাওয়া শ্রমিকরা শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে বুধনের মতো পেশা বদলের কথা ভাবছে। করোনার কারণে কেউ কাজে ডাকছে না। যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় কাছাকাছি শহরে কাজে যেতে পারছে না। কম মূলধনের মুদিখানা ও অন্যান্য গুমটির মালিক বিক্রির অভাবে সংসার চালাতে না পেরে অবসাদে ভুগছে। যাঁরা অন্যের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করত, মুড়ি ভাজত, উঠোন-খামার গোবর দিয়ে নিকনোর কাজ করত, তাঁরা কাজ হারিয়েছে।
সাঁকরাইল থানার (ঝাড়গ্রাম জেলা) ধানঘোরি গ্রামের ছবি মাইতি লকডাউনের ফলে তাঁর ব্যক্তিগত অসুবিধার সঙ্গে এলাকার অসুবিধার কথা শোনালেন। পারিবারিক অসচ্ছ্বলতা, প্রান্তিক এলাকায় বাস। যোগাযোগের অসুবিধার মধ্যে স্নাতক হওয়ার পর নেট পরীক্ষায় বসার জন্য অনেক আশা নিয়ে ফর্ম ফিলাপ করেছিলেন ছবি। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিক না থাকায় পরীক্ষায় বসতে পারেননি। তাঁর পক্ষে গাড়িভাড়া করে কলকাতা যাওয়া সম্ভব হয়নি। তাঁর কাছে একটা বছর নষ্ট মানে বিরাট ক্ষতি। তিনি জানালেন, এসব এলাকায় রোজ বাজার বসে না, কয়েকটি গ্রামের মধ্যে একটি হাট বসে। এলাকার মানুষ সারা সপ্তাহের সবজি ও অন্যান্য জিনিস হাট থেকেই কেনেন। এই এলাকায় হাট বসে সোমবার। মাঝে সোমবার দিনটিতে লকডাউন হওয়াতে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই হাট বসছে না। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই ভীষণই সমস্যায় পড়েছে। সমস্যা একা থাকা বয়স্ক মানুষদের। কেউ উঁকি মেরে খোঁজও নেয় না, তার ওপর চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল অবস্থা। সেই জড়িবুটিতেই আস্থা রাখতে হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল ‘জঙ্গলমহল উদ্যোগ’-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক প্রিয়ব্রত বেরার সঙ্গে। কলকাতার ছেলে হলেও বাবা রেঞ্জার হওয়ার সুবাদে কিশোর বয়সটা জঙ্গলমহলেই কাটিয়েছেন। তখন থেকেই জঙ্গল ও জঙ্গল এলাকার মানুষের সঙ্গে সখ্যতা। তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে জানালেন, একমাত্র সরকারি চাকুরীজীবীদেরই রোজগার বন্ধ হইনি, বাকিদের অবস্থা খুবই খারাপ। ১০০ দিনের কাজ হলেও কোনও ধারাবাহিকতা নেই। খাপছাড়া করে কাজ হচ্ছে। কাজের থেকে টাকা লুটে নেওয়ার ধান্দাই বেশি। জঙ্গলমহলের তিনটি জেলাজুড়ে প্রকৃতির বুকে রয়েছে কত না দর্শনীয় স্থান। চিল্কিগড়ের রাজবাড়ি, কনকদুর্গা মন্দির, গোপগড়, কাঁকড়াঝোর, ঘাগরা জলপ্রপাত, মুকুটমণিপুর, দুয়ারসিনি, অযোধ্যা পাহাড় ইত্যাদি। কিন্তু পর্যটন ব্যবসা এখন পুরোপুরি বন্ধ।
এই অসহনীয় পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসেছে বহু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তারা জঙ্গলের ভিতরে লোধা, শবর, কুড়মিদের গ্রামে গিয়ে কিছু কিছু সাহায্য পৌঁছে দিয়ে আসছে। কিন্তু চিকিৎসা পরিষেবা অত্যন্ত খারাপ। প্রিয়ব্রত মনে করেন, এই এলাকায় বনজ ও কৃষিজাত সম্পদ সংগ্রহ ও উৎপন্ন করা হয়, পশু পালন করা হয়, বনৌষধি ইত্যাদির জন্য এখানে যদি শিল্প স্থাপন করা হয়, তাহলে এখানেই বহু মানুষের কর্মসংস্থান হবে। সেই সঙ্গে কারিগরি শিক্ষারও উন্নতির প্রয়োজন। এ বিষয়ে সরাসরি এখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হবে। নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলে লাভ হবে না। ওদের সুবিধা-অসুবিধার কথা, ওরা কী চায়, তা ওদের থেকে সরাসরি শুনতে হবে। তিনি আরও জানালেন সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে জঙ্গলমহলের সাঁওতাল, লোধা, শবর ইত্যাদি জনজাতি ও দারিদ্রসীমার নীচে বাস করা পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের। শুধুমাত্র সচ্ছ্বল ও সচেতন পরিবারের ছেলেমেয়েরায় নতুন শিক্ষা পদ্ধতির সুযোগ নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে।
স্পষ্ট ছবি পাওয়া গেল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার নয়াবসত গ্রামের ‘পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু বিদ্যাপীঠ’-এর পরিচালন সমিতির বক্তব্য থেকে। আবাসিক এই স্কুলটিতে আদিবাসী পরিবারের ৪২৩ জন ছাত্রছাত্রী পড়া শোনা করত। খাতায় কলমে এখনও করে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি তা বলছে না। ১৭ মার্চ সরকার সমস্ত অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ ইত্যাদি ছুটি ঘোষণা করে এবং আবাসিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে বলা হয়। মাঝে এক সময় বোর্ড থেকে কিছু প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে স্কুলে স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। স্কুল সেগুলি জেরক্স করে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করে দেন। এই পর্যন্তই, তারপর আর স্কুলের সঙ্গে তাদের কোনও যোগাযোগ নেই বলা যায়। কারণ অনলাইনে পড়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের মোবাইল ফোন নেই, তারা ফোনের ব্যবহারও জানে না। স্কুলের প্রধানশিক্ষক বিনোদ মণ্ডল জানালেন, তিনি ও স্কুলের পরিচালন কমিটির সভাপতি অভিজিৎ রায়-সহ অন্যান্য সদস্যগণ মনে করেন ওদের বাড়ি না পাঠিয়ে স্কুলের হস্টেলে রাখলে ওরা ওখানে থেকেই অন্যভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারত। দশম শ্রেণির ৭৮ জন পড়ুয়ার মধ্যে মাত্র ১২ জনের পরিবারের সঙ্গে স্কুল যোগাযোগ রাখতে পেরেছে। প্রশ্ন, এই ৪২৩ জন ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যতের দায়ভার কে নেবে? এই প্রশ্নের মতো লকডাউন সমগ্র জঙ্গলমহলকেই অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
রোশেনারা খান : লেখিকা ও সমাজকর্মী
ছবি ঋণ : লেখিকা ও ইন্টারনেট
Comments are closed.