সবার ওপরে মহানায়ক
সুনাসীর চক্রবর্তী
আমাদের ছোটবেলার অত্যন্ত চেনা একটা নাম উত্তমকুমার (Uttam Kumar)। আমার কেন, বোধহয় প্রতিটা বাঙালির খুব কাছের মানুষ তিনি। তবুও আজ একবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি তাঁকে যেভাবে ভুলতে বসেছে, তা ক্ষমার অযোগ্য। গতবছর প্রতিটা প্রথমসারির বাংলা চ্যানেল ঘুরিয়ে দেখেছি, এই দিনটায় কোথাও উত্তমের একটা সিনেমা নেই। অথচ, ছোটবেলায় এই সময়টায় নিয়ম করে ‘উত্তমকুমার রেট্রোস্পেক্টিভ’ হতো। টানা ৭ দিন ৭টা সিনেমা। এখন কোথায় কী?
বাংলা ছবিতে উত্তমকুমারের কী অবদান তা এখনকার অনেকেই জানে না। স্টারডম কাকে বলে সেটা বাঙালিকে উনিই শিখিয়েছিলেন। ৫ ও ৬-এর দশকের মহিলাদের হার্টথ্রব, পুরুষদের আইডল ওই ধুতিপাঞ্জাবি পরা লোকটা। আজও আমাদের জ্যাঠা-কাকাদের জিজ্ঞেস করলে, গলায় কী অসম্ভব শ্রদ্ধা ঝরে পড়ে। আমি একরকম বাধ্য হয়েই দেখতাম ওই সিনেমাগুলো, কারণ তখন তো ডিডি বাংলা ছাড়া আর কোনও চ্যানেল ছিল না। ক্রমশ ভালো লাগতে শুরু করে এবং বাকিটা বলাই বাহুল্য! আমার বেশ কিছু বন্ধুবান্ধবের সাথে আমার উত্তম-সৌমিত্র নিয়ে প্রচুর তর্ক হয়েছে। কিন্তু আজ মনে হয়, এই তর্ক অর্থহীন। উত্তম অতুলনীয়। ওই নায়কোচিত চেহারা, তাকানো, অসম্ভব ক্যারিশমাটিক স্ক্রিন প্রেজেন্স– এগুলো সৌমিত্রের ছিল না।
যারা ওঁর অভিনয়ের সমালোচনা করেন, তারা নিশ্চিতভাবেই সব সিনেমা দেখেননি। উত্তম সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে জানতেন। তাই একটা সময়ের পর ওই তথাকথিত রোমান্টিক রোল করা ছেড়ে দিয়েছিলেন। যে কোনও চরিত্রে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা ছিল তাঁর। ৬-এর দশকের শেষ থেকেই নিজেকে চরিত্রাভিনেতায় বদলে নিয়েছেন। ‘অগ্নিশ্বর’ থেকে ‘সন্ন্যাসী রাজা’ বা ‘স্ত্রী’, ‘যদুবংশ’ তার প্রকৃত উদাহরণ। আবার ‘বাঘবন্দি খেলা’ বা ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’তে খলচরিত্রেও সমান পারদর্শী। এছাড়া করেছেন, ‘ছদ্মবেশী’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘মৌচাক’ এবং তাঁর অভিনীত শেষ ছবি ‘ওগো বধূ সুন্দরী’তে রসবোধকে নিয়ে গেছেন অন্য মাত্রায়।
উত্তমের অভিনয় নিয়ে কারওর মনে বিন্দুমাত্র সংশয় থাকলে তাঁর ‘অগ্নীশ্বর’ দেখা উচিত। সুচিত্রার সঙ্গে তাঁর জুটি নিয়ে একটা শব্দ খরচ করারও দরকার নেই। অধ্যাবসায় এমনই ছিল, গানের দৃশ্যে অভিনয় করার আগে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে গানটা নিজে তুলতেন। সত্যজিতের মতো পরিচালককে তাঁকে নিয়ে স্ক্রিপ্ট লিখতে বাধ্য করেছেন, এমনই ছিল তাঁর প্রভাব। প্রেমিক-স্বামী-দাদা-বাবা-গোয়েন্দা-জমিদার-ডাক্তার হেন কোনও চরিত্র নেই যাতে উত্তমের কাজ মনে রাখার মতো নয়। তাই চিবিয়ে চিবিয়ে বললেও অরুণ চ্যাটার্জিই ‘ইন্ডাস্ট্রি’। বাংলা সিনেমায় তিনিই ‘মহানায়ক’, লাস্ট স্টেশন। আক্ষরিকই তিনি উত্তম, বাকিরা বড়জোর মধ্যম!
Comments are closed.