যুগান্তর পত্রিকার ইতিহাস
ইন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাঙালি অনেক গুণে গুণান্বিত হলেও একটি বিষয়ে তেমন সজাগ নয় বলে অনেকেই আক্ষেপ করে থাকেন। স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও এ সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ক্ষোভ জানিয়েছিলেন এভাবে : ‘সাহেবরা যদি পাখি মারিতে যান, তাহারও ইতিহাস লিখিত হয়। বাংলার ইতিহাস নাই। গ্রীনল্যান্ডের ইতিহাস লিখিত হইয়াছে, মাওরি জাতির ইতিহাস আছে, কিন্তু যে দেশে গৌড়, তাম্রলিপ্ত, সপ্তগ্রামাদি নগর ছিল, যেখানে নৈষধচরিত, গীতগোবিন্দ লিখিত হইয়াছে, যে দেশ উদয়নাচার্য, রঘুনাথ শিরোমণি ও চৈতন্যদেবের জন্মভূমি, সে দেশের ইতিহাস নাই।’ কথাগুলি মনে এল এক সময়ের বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকা যুগান্তরের সম্পর্কে দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের বইটি পড়তে গিয়ে। বইটির নাম : ‘সেই সব দিনরাত্রি যুগান্তর এবং আরও কিছু’। মনে পড়ে গেল ১৯৯১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বিষণ্ন দিনের কথা। সেদিনই যুগান্তর পত্রিকার সাসপেনসন অফ ওয়ার্কের নোটিশ টাঙানো হয়েছিল নোনাপুকুর ট্রাম ডিপোর উল্টোদিকে সেই সময়ের যুগান্তর পত্রিকা অফিসে। বছর আড়াই পর ২৩ অক্টোবর ১৯৯৩ সালে দুর্গাপুজোর মহাষ্টমীতে পুনঃপ্রকাশ ঘটে যুগান্তরের। কিন্তু শেষপর্যন্ত ১৯৯৬ সালের ২০ জুলাই যুগান্তর পত্রিকার প্রকাশিত হয় শেষ সংখ্যা।
ঐতিহ্যপূর্ণ দৈনিক পত্রিকা হিসেবে ১৯৩৭ সালের জন্মলগ্ন থেকেই যুগান্তরের বিশেষ সমাদর ছিল পাঠকমহলে। অনেকেরই হয়তো মনে আছে গত শতকের পাঁচের দশকে যুগান্তরই ছিল সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা সংবাদপত্র। এই পত্রিকার জনপ্রিয়তার ভিত্তিভূমি পক্ষপাতহীন সংবাদ পরিবেশন।
‘সেই সব দিনরাত্রি যুগান্তর এবং আরও কিছু’ গ্রন্থের লেখক দেবব্রত মুখোপাধ্যায় দীর্ঘ সময় যুগান্তরের বিভিন্ন দায়িত্বশীল কর্মে ব্রতী ছিলেন। সেইসঙ্গে যুগান্তর পত্রিকার প্রাক্তন যুগ্ম-সম্পাদকও। গ্রন্থটি তিনটি পর্বে বিন্যস্ত। প্রথম পর্বে মোট পনেরোটি অধ্যায় আছে– শেষের সেদিন…, যাত্রা শুরু যুগান্তরের, জনপ্রিয় যুগান্তর, কিছুটা ব্যক্তিগত, সাংবাদিকের টাকা-আনা-পয়সা, যুগান্তর কর্তৃপক্ষের ‘ভুল’, কিছু মুখ কিছু ছবি : এক, কিছু মুখ কিছু ছবি : দুই, বাংলা সংবাদপত্রে নতুন হাওয়া, বিবেকানন্দ বিসর্জন, যুগান্তরে নতুন অধ্যায়, প্রবাস-প্রশিক্ষণ, আরও এক তারকার বিদায়, অন্য কোনওখানে, যুক্তফ্রন্ট-ভাঙন-শিশিরকুঞ্জ। দ্বিতীয় পর্বে চোদ্দোটি অধ্যায়– ঘরে ফেরার দিন, সম্পাদক-মালিক-সম্পাদকীয়, বাংলাদেশ-আকাশবাণী, কলকাতায় মুজিব, সত্তরের পশ্চিমবঙ্গ, পরিবর্তনের হাওয়া, জরুরি অবস্থার ‘হামাগুড়ি’, নতুন উদ্যমে আবার, দুটি মৃত্যুর স্মৃতি, সাফল্যের স্বাদ, পূর্ব ইউরোপের এক ঝলক, আজকাল-পরশুর গল্প, নতুন দায়িত্ব, কিছু নতুন মুখ, ঘটনাবহুল ১৯৮৪। তৃতীয় পর্ব তুলনায় কিঞ্চিৎ ছোট। নয়টি অধ্যায় সূচিত হয়েছে এই পর্বে। তা হল : নতুন প্রযুক্তি-নতুন বিপত্তি, রাজনীতির টানাপোড়েন, লড়াই তবু চলছিল, রাজীব-রাশিয়া-ভারত উৎসব, অনিবার্য পরিণীতির দিকে, নতুন দৈনিকের জন্ম, পুনঃপ্রকাশের প্রস্তুতি, ক্ষণস্থায়ী বসন্ত, হায় একী সমাপন…।
সুদীর্ঘ বেশ কয়েক দশক জুড়ে দেবব্রত মুখোপাধ্যায় যেহেতু যুগান্তর পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সেহেতু সব কিছুই তাঁর হাতের তালুর মতোই চিরচেনা। তাঁর পিতৃদেব পাঁচুগোপাল মুখোপাধ্যায়ও সাংবাদিকতা সূত্রে ঘনিষ্ঠ ছিলেন এই পত্রিকার সঙ্গে। তাই বহু অজানা কাহিনি দেবব্রত তুলে ধরেছেন নিপুণভাবে। ডা. বিধানচন্দ্র রায়কে লক্ষ্য করে ‘বাংলাদেশের জ্যাঠামশাই’ কিংবা জ্যোতি বসুকে লক্ষ্য করে ‘বেতনভুক বিপ্লবী’ এরকম নানান মজার কথা যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি ম্যাগসাইসাস পুরস্কারে সম্মানীত অমিতাভ চৌধুরীর বিশেষ প্রতিবেদন ‘পণ্ডিতজীর সঙ্গে বনগাঁয়ে’। শান্তিনিকেতনের আরও এক অমিতাভ চৌধুরীর প্রসঙ্গও এসেছে। তাঁদের দু’জনের একই নাম হওয়ায় বিভ্রান্তির গল্পও এসেছে শিশির ভাদুড়ীর পদ্মভূষণ প্রত্যাখ্যান করা নিয়ে। যুগান্তর পত্রিকার বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, দক্ষিণারঞ্জন বসু, মৃণালকান্তি বসু, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, শিশির চক্রবর্তী, অনিল ভট্টাচার্য, নিরঞ্জন সেনগুপ্ত, মহেন্দ্র চক্রবর্তী, প্রফুল্লরতন গঙ্গোপাধ্যায়, মিহির গঙ্গোপাধ্যায়, সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত, সুধীর সেন, কৃষ্ণ ধর, নিখিল সরকার (শ্রীপান্থ)-এর কথাও এসেছে। এছাড়া তুষারকান্তি ঘোষের কথা তো আছেই। আলোকচিত্রী হিসেবে তারক দাস, পান্না সেন, গণেশ সিংহ এবং শ্যামল বসুর কথাও আছে এ গ্রন্থে। পরবর্তী সময়ে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, অমিতাভ চক্রবর্তী, প্রণবেশ চক্রবর্তী, প্রফুল্ল রায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরাঙ্গ ভৌমিকের কথাও সযত্নে পাঠকের দরবারে দেবব্রত হাজির করেছেন।
এত বছরের প্রাচীন জনপ্রিয় দৈনিক সংবাদপত্র যুগান্তর-এর বহু গোপন কাহিনিও এই গ্রন্থটিকে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে মূল্য বৃদ্ধি করেছে। যে পত্রিকার কোনও ইতিহাসই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি এতদিন সেই খেদ মিটিয়েছেন লেখক। তবে এটি বলা যায় সবেমাত্র শুরু। আরও অনেকে যখন এই দৈনিক পত্রিকা নিয়ে বই লিখবেন তখনই তা সর্বাঙ্গ সুন্দর হবে। গ্রন্থটির মূল্য আরও একটি কারণে উল্লেখ করার মতো। শেষের দিকে ‘স্মৃতিতে যুগান্তর’ নামে ২৮টি ছবি। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন এটি, কেননা পাঠক অন্তত পুরনো দিনের স্মৃতি হিসেবে সেগুলি দেখার সুযোগ পাবেন।
প্রকাশক হিসেবে জন্মলগ্ন থেকেই ‘সহজপাঠ’ বহু পাঠকের সমাদর অর্জন করেছে। যুগান্তর পত্রিকার ইতিহাস তুলে ধরার জন্য আবারও পাঠককুলের ধন্যবাদার্হ্য এই প্রকাশনা সংস্থা।
————–
সেই সব দিনরাত্রি যুগান্তর এবং আরও কিছু।। দেবব্রত মুখোপাধ্যায়।। সহজপাঠ।।
মূল্য ৫০০ টাকা
Comments are closed.