কোভিড বিজয়ে আগামীর পদক্ষেপ
ড. স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী
ইনফ্লুয়েঞ্জা, পোলিও, ডেঙ্গু– এই সমস্ত রোগকে ভয় না পেয়ে বা আতঙ্কিত না হয়ে যেমন দিব্যি আমরা বেঁচে ছিলাম বরং কোভিড ১৯-কেও নিত্যদিনের সঙ্গী করে সুস্থভাবে এবং নির্ভাবনায় জীবন কাটানোর পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। করোনা ভাইরাসের চরিত্র আরএনএ জাতীয় হলেও অনান্য দেশের তুলনায় ভারতের মৃত্যু হার যে কোনও কারণে বেশ কম। এইসময় মৃত্যুর হার দুই শতাংশেরও কম, যা খুবই সামান্য। এই মুহূর্তে এক কোভিড বিশেষজ্ঞ কোভিড-১৯ নিয়ে একটি ট্যুইট করে লেখেন, ‘করোনা ভাইরাসকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের মাসের-পর-মাস বা বছর কাটিয়ে দিতে হবে। তাই এই চরম বাস্তবকে মেনে নিয়েই হাসিখুশিভাবে জীবনকে উপভোগ করা শিখতে হবে। অযথা এসব নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে জীবনকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললে আখেরে ক্ষতি হবে নিজেরই।’
সারা পৃথিবীর প্রতিটি দেশই নিজস্ব নিজস্ব বিশেষ জীবনশৈলী নির্দিষ্ট করে নিউনর্মাল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। গ্ৰামবাংলা আর শহরেরক্ষেত্রে কন্টেনমেন্ট জোনগুলোকে আলাদা ভাবে নজর রাখতে হবে ও স্বাস্থ্যবিধির মান্যতার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। দেশে এই মুহূর্তে করোনামুক্ত হয়েছে সাইত্রিশ লক্ষ, যা খুবই আশাপ্রদ। ভাইরাসের মৃত্যুহার ফি বছরের ডেঙ্গু ভাইরাসের থেকে অনেক কম। বিভিন্ন পরিবেশ বিজ্ঞানীদের কথা অনুযায়ী, গরমের সময় এই ভাইরাসের প্রভাব কমবে না। যেমন- ব্রাজিল এবং আর্জেন্তিনায় দেখা গেছে, গরমে ভাইরাসের সংক্রমণ আরও দ্রুত হারে বেড়ে গেছে। গ্যালন গ্যালন গরম জল খেয়ে বা বারবার প্রস্রাব করলেই যে করোনা ভাইরাসকে ধ্বংস করা সম্ভব, এমনটা পুরোপুরি ভুল ধারণা। বরং বারবার হাত ধুয়ে এবং ১-৮ মিটার দূরত্ব বজায় রাখলেই এই ভাইরাসকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। বাড়িতে কোনও করোনা রোগী না থাকলে বাড়ি জীবাণুমুক্ত করার প্রয়োজন পড়ে না। কার্গো প্যাকেজ, পেট্রোল পাম্প, শপিং কার্ট বা এটিএম থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর ভয় তখনই আর থাকবে না- শুধু এসব জায়গায় গেলে হাত পরিষ্কার করে ধুয়ে নিন আর স্বাভাবিক জীবনযাপন করুন।
কোভিড-১৯ খাবার থেকে হওয়া কোনও সংক্রমণ নয়। এখনও পর্যন্ত এমন কোনও তথ্য মেলেনি যে বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করলে এই সংক্রমণ ছড়িয়ে যেতে পারে। এটা আসলে ফ্লু-র মতো। হাঁচি, কাশি বা সর্দি থেকে যে ড্রপলেট ছড়ায়, সেখান থেকেই সংক্রমণ হতে পারে। অন্যান্য যেকোনও এলার্জি বা ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রেও গন্ধ না পাওয়ার মতো সমস্যা হতে পারে কিন্তু তার মানেই যে এটা করোনার লক্ষণ এমনটা নয়। বাড়িতে থাকলেই বার বার জামাকাপড় বদলে ফেলার বা সময়ে সময়ে স্নান করে নেওয়ার দরকার পড়ে না। আমাদের চারপাশের বাতাস সম্পূর্ণ নির্মল। তাই আপনি চাইলে দূরত্ববিধি বজায় রেখে পার্কে বা বাগানে ঘুরে বেড়াতে পারেন। হালকা ব্যায়াম করতে হবে। নিজস্ব মানসিক সুস্থতার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে অযথা বিচলিত হয়ে পড়লে চলবে না। আসলে কারওর সঙ্গে সরাসরি মেলামেশা করলে বা দূরত্ববিধি না মানলে এই সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যায়। হাত ও পা পরিষ্কার করে ধোয়ার জন্য যে কোনও সাধারন সাবানই যথেষ্ট, তার জন্য অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল সাবানের কোনও প্রয়োজন নেই, কারণ এটি ব্যাকটেরিয়া নয়।
বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করার ক্ষেত্রেও কোনও সমস্যা নেই, তবে আপনি চাইলে খাবারটি গরম করে নিতে পারেন। বাইরে থেকে ঘুরে আসা জুতোর মাধ্যমেও এই সংক্রমণ যাতে না ছড়ায় তাতে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। সারা পৃথিবীজুড়ে যেসব বিজ্ঞানীরা বছরের পর বছর ধরে ভাইরাস নিয়ে কাজ করেন তাঁরা দেখেছেন, এই ভাইরাসের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ড্রপলেট থেকেই সংক্রমণ ছড়ায়।
কোভিড-১৯ কোনও জাত বা ধর্ম বিচার করে না। সকলের মধ্যেই এটা ছড়িয়ে যেতে পারে। ভিনিগার, আখের রস, আদা এসব জিনিস শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে কিন্তু এগুলো খেলেই যে করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এমনটা নয়। হাতে গ্লাভস পরাটাও সুরক্ষিত নয়। কারণ গ্লাভসের মধ্যে ভাইরাস লেগে থাকলে সেই হাত যখন আপনি মুখে দেবেন সেখান থেকে ভাইরাস আপনার শরীরে চলে যেতে পারে। তার চেয়ে কিছু সময় অন্তর পরিষ্কার করে হাত ধুয়ে নেওয়াটাই সবচেয়ে সুরক্ষিত উপায়। এছাড়া দীর্ঘক্ষণ মাস্ক পরে থাকলে আপনার শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা হতে পারে ও শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তাই শুধুমাত্র ভিড়ের জায়গাতেই মাস্ক পরে থাকার জন্য চিকিৎসকরা পরামর্শ দিচ্ছেন।
সর্বক্ষণ পরিচ্ছন্ন এবং ঘরের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে বসে থাকলে কিন্তু শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যেতে পারে। তাই আপনি যদি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বর্ধনকারী খাবার খেয়ে থাকেন, তাহলে নিয়ম করে বাইরে বেরিয়ে হাঁটাচলা করার অভ্যাস থাকা দরকার। বাড়িতে বসে শুধুমাত্র মিষ্টি, ভাজাভুজি, মশলাদার খাবার খাওয়ার বদলে খোলামেলা জায়গায় যত বেশি নির্মল বাতাসের সংস্পর্শে আসা যাবে ততই শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও বেশি বৃদ্ধি পাবে। এটা মাথায় রাখতে হবে আমাদের, কোভিডকে পিছনে ফেলে আগামী দিনের উদ্দেশে এগিয়ে যেতে হব।
ড. স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিজ্ঞানী
ছবি ঋণ : ইন্টারনেট
Comments are closed.