বিশ্ব-মানব
অদিতি মজুমদার
মানববাবু না থাকলে কত কিছুই অজানা থেকে যেত আমাদের!
বিশ্বসাহিত্য পড়ার লোভ থেকে ভর্তি হয়েছিলাম তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে। শুধু পড়লেই তো হবে না, জেনে নিতে হবে কী ভাবে পড়ব একটি গল্প, উপন্যাস অথবা নাটক। মানববাবু খুলে দিয়েছিলেন মনের সেই জানালা। শিখিয়েছিলেন, কেমন হবে একটি টেক্সট-কে পড়া। শিখিয়েছিলেন, কেমন করে ব্যাখ্যা করতে হয় একটি পাঠ-কে। আসলে তৈরি করেছিলেন অসংখ্য পাঠক। যে শুধু পড়ার জন্য পড়ে না, একটি টেক্সট-কে ব্যাখ্যা করতে পারে, পারে প্রশ্ন করতে। হ্যাঁ, মানববাবু আমাদের প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিলেন। মানববাবুর প্রতিটি ক্লাস ছিল নতুন অভিজ্ঞতার কেন্দ্র। পড়াতেন ‘চতুরঙ্গ’-র সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে ইউ আর অনন্তমূর্তি-র ‘সংস্কার’! সেই ক্লাসে এই দুই টেক্সট-এর বাইরে আরও কত শত আধুনিক ভারতীয় গল্পের আলোচনা ঢুকে পড়ত অনায়াসে!
শুধু গল্পই নয়, আলোচনায় নিয়ে আসতেন তিনি সিনেমাও। মনে আছে, ‘সংস্কার’ পড়ানোর সময়ে বলেছিলেন বার্গম্যানের ‘সেভেন্থ সিল’ ছবির কথা। ‘মৃচ্ছকটিক’ পড়াতে গিয়ে আলোচনায় চলে আসত কালিদাসের নাটক এবং সেই সূত্রে ভরতের নাট্যশাস্ত্রের কথা। একই দক্ষতায় পড়াতেন লাতিন আমেরিকার সাহিত্য। হুয়ান রুলফো থেকে গার্সিয়া মার্কেজ, আলেহো কার্পেন্তিয়ার, মিরোশ্লাভ হোলুব, কার্লোস ফুয়েন্তেস, নিকানোর পাররা বা এমে সেজেয়ার— সব কিছুই ছিল তাঁর নখদর্পণে। জাদুবাস্তবতা পড়ানোর সময়ে এমন সব গল্পের কথা বলতেন, যেন মনে হত এক মায়া-র মধ্যে নিয়ে চলেছেন আমাদের! আমরা হতভম্বের মতো পথ চলছি তাঁর পিছন-পিছন। এক দিকে যখন নিজের হাতে ঘষেমেজে তৈরি করছেন ছাত্রছাত্রী, তৈরি করছেন তাদের সাহিত্য পড়ার মন, খুলে দিচ্ছেন মনের জানালাগুলো; অন্য দিকে নিঃশব্দে নিরন্তর পরিশ্রমে করে চলেছেন বিশ্বসাহিত্য অনুবাদের কাজ। অনুবাদ বলছি বটে, মানববাবুর কিন্তু পছন্দ ছিল তরজমা শব্দটি। বলতেন, অনুবাদে অণু পরিমাণ বাদ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা, আর তরজমায় জমা থাকে অনেক কিছু!
শুধু লাতিন আমেরিকার সাহিত্য নয়, অনুবাদ করেছেন ইউরোপের সাহিত্য। চেকোস্লোভাকিয়া এবং পোলান্ডের কবিদের কবিতা। তাঁর আস্তিন থেকে একের পর এক বেরিয়ে এসেছে আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যের অনুবাদ। প্রেমচাঁদ, ইসমত চুগতাই, ভৈকম মহম্মদ বশীর। এক সময়ে আমাদের মধ্যে এক মজার আলোচনা হত। মানববাবু যে-সাহিত্যিকের লেখা বাংলায় অনুবাদ করেন, কিছুদিন পর-ই তিনি পুরস্কার পান! শুনে মৃদু হাসতেন স্যার। বলতেন, কী যে বলো তোমরা! আর নিঃশব্দে চালিয়ে যেতেন তাঁর কাজ। শুধু অনুবাদ নয়, লিখেছেন নিজস্ব কবিতা। ‘ল্যাম্পপোস্টের বেলুন’ অথবা ‘যে পুতুল পালিয়ে গেল’-র মতো আরও অনেক ছোটদের উপন্যাস। ক্রিকেটের ইতিহাস লিখেছেন সমান যত্নে। প্রাবন্ধিক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়-ও একই উজ্জ্বলতায় বাংলা সাহিত্যে ভাস্বর।
ব্যক্তিগত পরিসরে মানববাবুকে দেখার সৌভাগ্যও হয়েছে খানিক। খুব রসিক মানুষ ছিলেন। কথা নিয়ে মজার খেলা করতে ভালবাসতেন। ইংরেজিতে যাকে বলে pun। যেমন, স্যার টেনিস দেখতে ভালবাসেন জেনে জিজ্ঞাসা করেছে কেউ— স্যার, আজ খেলা দেখলেন? মৃদু হেসে মানববাবুর উত্তর— টেনিস আর দেখব না ভাবছি, খুব কমার্শিয়াল হয়ে উঠছে সব! লিয়েন্ডার pays, মণিকা sells! কেউ জানতে চেয়েছে— স্যার, ‘টু হুম ইট মে কনসার্ন’-এর বাংলা কী হতে পারে? স্যার বল্লেন— লেখো, ‘যার মাথাব্যথা’। বাড়িতে ফোন করে ভুলক্রমেও যদি জিজ্ঞেস করেছি ‘স্যার, কেমন আছেন?’ উত্তর আসত, ‘তোমায় কেন বলব! তুমি কি ডাক্তার?’
ক্রিকেট দেখতে ভালবাসতেন, দেখতেন কমার্শিয়াল হিন্দি সিনেমাও। আফ্রিকান লাল টি-শার্ট, জিনস্ আর লম্বা ছাতা নিয়ে যাদবপুরে আসতেন ছোটখাটো চেহারার মানববাবু। চেহারায় ছোটখাটো হলেও অতিকায় ছিল তাঁর ছায়া, বিশাল ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। মানববাবু ছিলেন যথার্থ এক বিশ্বনাগরিক। তাঁকে দেখলে আমার মনে হত তাঁর পিঠে আছে অদৃশ্য ডানা, সেই ডানায় ভর করে তিনি উড়ে বেড়াচ্ছেন এক দেশের সাহিত্য থেকে অন্য দেশের সাহিত্যে। যেমন নিঃশব্দে ছিলেন তেমনই নিঃশব্দে চলে গেলেন। বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে গেলেন তাঁর কাজ দিয়ে। বাংলা ভাষা হারাল তার একজন প্রধান সৈনিককে। আমরা হারালাম আমাদের প্রিয় শিক্ষককে।
মানববাবু পাড়ি দিলেন মহাবিশ্বে। আমরা আজ অবনত।
অদিতি মজুমদার : প্রাক্তনী, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ। চিত্রনাট্যকার।
Comments are closed.