করোনা আবহে প্রকৃতিতে নেই আগমনীর সুর, লকডাউনে কাটছাঁট মাতৃবন্দনাতেও
রাজর্ষি পাল
অগস্ট মাসের গোড়ার দিক। ভরা শ্রাবণে ভিজছে প্রকৃতি। বৃষ্টির এই জলকেলি সম্পন্ন হলেই ফের নীলাভ হবে আকাশ। দিগন্তবিস্তৃত মহাশূন্যের মাঝে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত খেলে বেড়াবে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। জানান দেবে, আসছে শরৎ। আর তখনই কোনও একদিন প্রভাতে আকাশবাণীতে বেজে উঠবে আগমনীর সুর।
এই চিত্রটা প্রতিবছরের দুর্গাপুজোর ১০০ দিন বাকি থাকতে থাকতেই প্রকৃতিতে আসতে থাকে পরিবর্তন। টেলিভিশনের পর্দায় শুরু হয়ে যায় কাউন্টডাউন। কিন্তু এ বছরের দৃশ্যটা আলাদা। প্রাণঘাতী ভাইরাস করোনা আর তার জেরে লকডাউনের সাঁড়াশি আক্রমণে এ বছর মাটি হয়ে যেতে বসেছে দুর্গাপুজোর প্রতিটি দিন। বছর শুরুর সময় মানুষ খুব ঘটা করে আড়ম্ভর সহযোগে আপন করে নিয়েছিল ২০২০-কে। তখন আর কে জানত, আনন্দ করে যে বছরটাকে মানুষ আপ্যায়ন করছে সেই বছরটাই দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে? দিন যত গড়তে থাকল তত দুর্ভাগ্যের আঁচ পেতে থাকল মানুষ। ফেব্রুয়ারি থেকেই দেশে থাবা বসাতে শুরু করেছিল করোনা। মার্চ মাসে তা ভয়াবহ হওয়ার তোড়জোড় শুরু করে। আর এই মারণ ভাইরাসকে আটকাতে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে শুরু করা হয় লকডাউন। যার জের আজও চলছে।
২০২০ সাত মাস কাটিয়ে আট নম্বর মাসে পা দিয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা নেই একেবারেই। কবে সব ঠিক হবে তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। এদিকে মা আসছেন আর মাসখানেকের মধ্যেই। এর মধ্যে সুদিন ফিরবে, তার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। বিজ্ঞানীরাও আশার আলো দেখাতে পারছেন না। বিশ্বের প্রতিটি দেশে জোরকদমে চলছে করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরির কাজ। কিন্তু সাফল্য পেতে এখনও অনেক পথ বাকি। অন্তত মাসখানেকের মধ্যে তো প্রতিষেধক বের হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। তাই দুর্গাপুজোর সময় করোনাকে সাথে করেই কাটাতে হবে আম বাঙালিকে। ঠাকুর দেখা প্রায় শিকেয় ওঠার জোগাড়। কারণ ইতিমধ্যে অনেকেই ঘোষণা করে দিয়েছে এ বছর তারা পুজো করবে না। আর যারা করবে তারাও নমো নমো করে সারবে মায়ের আরাধনা। কেউ আবার পুজো বাবদ ওঠা অর্থের বেশিরভাগটাই খরচা করবে করোনা যুদ্ধে। কেউ চিকিৎসা ক্ষেত্রে সাহায্য করবে, কেউ আবার দুঃস্থদের পাশে দাঁড়াবে। ইতিমধ্যেই অনেক পুজো কমিটি একথা ঘোষণা করে দিয়েছে। ফলে ঝাঁ-চকচকে মণ্ডপ ও প্রতিমা দেখার আশা এই বছরের জন্য তুলে রাখতে হবে।
কিন্তু দুর্গাপুজো মানে কি শুধুই প্যান্ডেল হপিং? নতুন জামাকাপড় কেনাও তো পুজোর আনন্দের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু এ বছর সে গুড়েও বালি। কারণ লকডাউন। মাসের-পর-মাস লকডাউন থাকায় অনেক কোম্পানি বন্ধ হয়ে পড়েছিল। ফলে কাজ হারিয়েছেন কর্মীরা। অন্যদিকে যেসব কোম্পানি ধুঁকতে ধুঁকতে চলছিল তারাও কর্মীদের বেতন হ্রাস করেছে। ফলে মধ্যবিত্ত বাঙালির পকেটে পড়েছে টান। তাই এবছর কতটা নতুন জামাকাপড় কেনা হবে তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ। আর নতুন জামাকাপড় কেনা না হলে ব্যবসায়ীদের নিদারুণ ক্ষতি। ফলে তাদের দুর্গাপুজো যে আহ্লাদে কাটবে, তা নয়। আসলে প্রতিটি ক্ষেত্রই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। করোনা থেকে বাঁচতে জারি হয় লকডাউন। লকডাউনের ফলে টান পড়ে চাকরি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে। যার ফলে অনেক ব্যবসায়ীর ব্যবসা যেমন মার খায় তেমনি অনেকে চাকরি খোয়ান বা কম টাকায় চাকরি করতে কার্যত বাধ্য হন। আর যেহেতু পকেটে পর্যাপ্ত টাকা নেই ফলে কাটছাঁট হয় আনন্দের খাতেও। যার রেশ পড়তে চলেছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবে।
এখানে আরও একটি কথা বলার আছে। যদিও বা খুঁজে পেতে একটি ভালো জামা বার করে ঠাকুর দেখতে বেরনোর কথা ভাবে মানুষ, সেখানে বিপদ। ওঁত পেতে রয়েছে করোনা। একটু অসতর্ক হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাই সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা অবশ্যম্ভাবী। অবশ্য শুধু সামাজিক দূরত্ব মেনে চললেই তো হবে না; পড়তে হবে মাস্ক। আর সুন্দর সেজেগুজে মাস্ক পরতে কারই বা ভালো লাগে? তারচেয়ে বাড়িতে বসে টেলিভিশনের পর্দায় পুজো পরিক্রমা দেখাই ভাল! তাই এ বছর প্যান্ডেল হপিং আর টুকটাক সেলফি বোধহয় ডুমুরের ফুল হয়ে উঠবে। তবে আশায় বাঁচে চাষা। এখনও তো মাসখানেক বাকি আছে। ঠাকুর ঠাকুর করে পরিস্থিতি যদি একটু শুধরে যায়! আশা করতে তো দোষ নেই!
ছবি ঋণ : ইন্টারনেট
Comments are closed.