মন ভাল নেই অখিল পালের
শুভাশিস মণ্ডল
লকডাউনে আঁধার নেমেছে অখিল পালের পরিবারে। না, কোনও সেলিব্রেটি নয় অখিল পাল। নিতান্ত সাদামাটা বছর ৪৫-এর মৃৎশিল্পী তিনি। অন্ধকারেও খুঁজে বেড়াচ্ছেন বাঁচার রসদ। বলতে পারি হাতড়াচ্ছেন! ফি-বছর তাঁর স্টুডিওয় দেখা মেলে ১৫ থেকে ১৬টি দুর্গা প্রতিমা। আর এবার! করোনা কেড়ে নিয়েছে জীবিকা। আয়ের ছন্দপতনে তাল কেটেছে জীবন-জীবিকায়। গত বছরের যেটুকু রসদ ছিল তাতে করে চলছিল ছেলে-মেয়ে আর বউকে নিয়ে। তারপর। সে এক অসহ্য গল্পগাথা। মারণ ভাইরাস করোনার আবহে লকডাউন সব ছারখার করে দিল। নেমে এল অদ্ভুত আঁধার। রুটিরুজিতে পড়ল টান।
হাওড়ার সাঁতরাগাছির মন্দিরপাড়া এলাকায় অখিল পালের স্টুডিও দুর্গা শিল্পালয়। ৬০ বছরের পৈতৃক ব্যবসা। বাবা ছিলেন জনপ্রিয় মৃৎশিল্পী স্বর্গীয় ঠাকুরদাস পাল। বাবার হাতেই অখিলের হাতেখড়ি ব্যবসাতে।
দুর্গা প্রতিমা ছাড়া বছরের অন্য সময় অন্যান্য দেবদেবীর প্রতিমা বানিয়ে সংসার চালান। অফসিজনে যে কাজগুলি হয় সেগুলিই এবার মার খেয়েছে। নিজমুখেই জানালেন, ‘অফসিজন চৈত্র মাসে যে ৫০-৬০ হাজার টাকার যে কাজ হত তা লকডাউনে বন্ধ হয়ে গেল। অন্নপূর্ণা ঠাকুর তিনটে অর্ডার থাকলেও গেছে একটা। বাকি দুটো পড়েই আছে। শীতলার অর্ডার পেতাম ৫-৬টা। রক্ষাকালীর অর্ডার পেতাম। সবকিছুতেই ঝাড় খেয়ে গেলাম।’ কথা বলতে বলতে চোখের কোণা চিকচিক করে উঠল অখিলের। এই অফসিজনেই ধারদেনা করে গণেশ-লক্ষ্মী তৈরি করে রাখতেন। পয়লা বৈশাখ বা অক্ষয় তৃতীয়ায় চাহিদা হবে বলে। কিন্তু সবকিছুকেই মাটি করল অসুররূপী করোনা।
প্রতিবছর ১৫-১৬টি দুর্গা প্রতিমা তৈরির অর্ডার পেতেন। এবার তাঁর শিল্পালয় ফাঁকা। অর্ডার নেই। দুটো বায়না হয়েছে তবে তা নগণ্য। হাজার টাকায় দুটি সংস্থা বায়না সেরেছে। এলাকা ছাড়াও রাঁচি, ওড়িশা, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া থেকে অর্ডার আসত। সব মিলিয়ে ৪-৫ কারিগর কৃষ্ণনগর, কাটোয়া, মুর্শিদাবাদ থেকে এনে কাজের চাপ সামলাতেন অখিল। কাজে সহায়তা করতেন স্ত্রী ও ছেলে। কিন্তু এবার সব হিসাব ওলটপালট হয়ে গেছে। লকডাউনে কাজ না থাকায় অন্নের টানে বেচতে হচ্ছে ফুল। বউ টুকটাক নাইটি সেলাই করে সংসার বাঁচার লড়াইয়ে তাঁর সাথী। ছোট মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে এভাবেই দিনযাপন অখিলের।
হাড় ঝিরঝিরে বাঁশের কাঠামো পড়ে রয়েছে শুধু। এ কাঠামো জানান দিচ্ছে লকডাউনে দেশের প্রতিটি দিন আনা দিন খাওয়া মানুষজনদের কঙ্কালসার চেহারা। গত বছরের ধারদেনাও কী ভাবে শোধ করবেন তা ভেবেই রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছে তাঁর।
আর্থিক সাহায্যের আবেদন করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখাপেক্ষী অখিল পাল। তাই তো অকপটে বলতে পারেন, ‘দিদি সবাইকেই দিয়েছে অনেক কিছু। দিন আনে দিন খায় তাঁদের অনেককেই দিয়েছে। কুমোরটুলিতে নজর দিয়েছেন। আমাদের মতো পাড়াগাঁয়ে যাঁরা কাজ করি তাঁদের দিকে একটু নজর দিক।’
লকডাউনের জেরে অন্ধকার নেমে এসেছে আন্দুল, কৃষ্ণনগর, বনগাঁ, অশোকনগর, হাবড়া, গোবরডাঙা-সহ রাজ্যের পটুয়াপাড়ায়। অখিল পাল আজ একটা উদাহরণ। রাজ্যের আনাচে-কানাচে কান পাতলে এরকম হাহাকার শোনা যাবে। এবার সবটাই কার্যত অন্ধকারে ডুবে গেছে। হতাশার চোখ জানান দেয়, আজ মন ভাল নেই…
Comments are closed.