উত্তরপ্রদেশের ‘বাহুবলী’, আর কিছু কথা…
অতীশ পাল
‘বিকাশ দুবে’, উত্তরপ্রদেশের এক মাফিয়া। যে ক’দিন আগেই একেবারে সিনেমার মতো অফিসার-সহ আটজন পুলিশকে মেরে ফেলল। ‘শোলের’ মতো নাটকীয় ভাবে সন্ত্রাসের চেহারাটাকে লাগু রাখার জন্য পুলিশ অফিসারের দুটো হাত কেটে ছেড়ে দিতে পারত কিন্তু করেনি কারণ শোলেতে ‘গব্বরে’র পেছনে রাষ্ট্রের মদত ছিল না, কিন্তু বিকাশের ছিল। হাজার হাজার সিনেমাতে আমরা দুষ্টের দমন দেখতে পাই নায়কের হাতে। সে নায়ক যদি পুলিশ হয় তবে তো সোনায় সোহাগা। সিনেমাতে দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ দেখা যায় বটে তবে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের জয়গান।
বাস্তবে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। বিকাশদের মতো মাফিয়া কোনও ভাবেই রাষ্ট্রের মদত ছাড়া জন্মাতে পারে না। বিকাশের পেছনে যে তাবড় তাবড় নেতারা ছিল তা তো অস্বীকার করা যায় না! সুতরাং বিকাশের মৃত্যু অবধারিত ছিল। কিন্তু এরকম একটি স্থূল চিত্রনাট্য কেন সাজাল রাষ্ট্র? রাষ্ট্র কি এতটাই বুদ্ধিহীন লোকেরা চালায়? একেবারেই তা নয়। আসলে রাষ্ট্র জেনে-বুঝেই এই অলীক চিত্রনাট্য তৈরি করে। কেন? রাষ্ট্র জানে এই অলীক চিত্রনাট্যে আমরা কিছুজন কিছুদিন হৈচৈ করব, দু’চারটে শীর্ণকায় মিছিল বের করব, ফেসবুকে কিছু পোস্ট করব– তারপর আবার ঝাঁকের কই ঝাঁকে। এই অলীক চিত্রনাট্য রাষ্ট্র কেন সাজায় সে কথায় পরে আসছি। বিকাশ দুবে, যার মাথার উপর নেতামন্ত্রীদের আশীর্বাণী বর্ষায়, সে কি এতটাই নির্বোধ যে সে-ভেবেছিল তার ব্যক্তিগত গুণ্ডামির রাজত্ব চালানোর জন্য এতগুলো পুলিশ খুন করবে বিশেষত এই ইন্টারনেটের যুগে। অথচ সে পার পেয়ে যাবে? একেবারেই না। আসলে হয়তো বিকাশকে দিয়ে এই খুন করানো হয়েছিল। ওই পুলিশ অফিসারটিকে সরিয়ে দেওয়া খুব জরুরি ছিল। সঙ্গে ফাউ হিসাবে আরও জনা সাতেক পুলিশের প্রাণ এখানে কেউ গুনতি করে নাকি? এরকম লক্ষ লক্ষ পুলিশ, লক্ষ লক্ষ সেনা অকারণে প্রাণ দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা কায়েম রেখেছে আর আমাদের দেশাত্মবোধে সুড়সুড়ি দিয়েছে।
বিকাশকে দিয়ে এই খুনের চিত্রনাট্য কিন্তু রচিত হয়েছিল অনেক আগেই আর একটুও ফাঁক না রেখে। সে চিত্রনাট্যে লেখা ছিল, আগে বিকাশের দুই সাগরেদদের খুন ও বিকাশের এনকাউন্টার পর্যন্ত। কয়েক মাস আগে হায়দরাবাদে চার ধর্ষকের এরকম এক এনকাউন্টারে মৃত্যু নিয়ে আমরা বেশকিছু সমাজসচেতন মানুষ আনন্দে নৃত্য করেছিলাম। সেই এনকাউন্টার নামক খুনে রাষ্ট্রের
জয়গান গেয়েছিলাম। সেই খুনের স্বপক্ষে অনেক কুযুক্তি সাজিয়ে ছিলাম। তাঁরাও অনেকে বিকাশ খুনের এই এনকাউন্টারের স্থূল নাটকীয়তায় হাসাহাসি করছেন। সেসময় অর্থাৎ হায়দরাবাদে ওই সমাজসচেতন মানুষ ওই অলীক কুনাট্য নিয়ে মাথা ঘামাননি কারণ তাঁরা ধর্ষকদের এরকম মৃত্যুর শাস্তি চেয়েছিলেন। বাস্তবে ধর্ষক মরল, নাকি নিরীহ কয়েকজনের প্রাণ গেল তা নিয়ে তাঁদের মাথা ঘামানোর সময় ছিল না। কারণ তাঁরা বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলেন।
ক’দিন আগে চিনের সঙ্গে লড়াইয়ে ভারতীয় সেনার মনোবল বাড়াতে মোদি গেল সীমান্তে। সেখানে এক সেনা হাসপাতাল পরিদর্শন করল। সেই সাজানো হাসপাতালের সেটে থেকে গেল অনেক খামতি। একটা বড় হলঘরে সারি সারি বেড, কোনও চিকিৎসার সরঞ্জাম নেই, বেডে আহত কোনও সৈনিকের দেখা নেই– সব আহত সেনা প্রায় পদ্মাসনে টানটান সুন্দর বিছানায় বসে দাঁত কেলিয়ে মোদিকে স্বাগত জানাচ্ছে। সেনার ভূমিকায় অভিনয় করা একজন নাকি দিল্লিতে গত বিধানসভায় বিজেপির প্রার্থী ছিল। এ নিয়ে অনেক সংবাদপত্রে সম্পাদকীয়, উত্তর-সম্পাদকীয় লেখা হল, আমরা মোদির নির্বুদ্ধিতায় দাঁত ক্যালালাম। রাষ্ট্র কিন্তু তার আসল কাজের কাজটা করে বেরিয়ে গেল। কী রকম? যারা ওই বরফ রাজ্যে একটা হলঘরে এতগুলো বেড, এত
অভিনেতা জোগাড় করতে পারল তারা কি কিছু চিকিৎসা সরঞ্জাম বা আহত সেনা দিয়ে সেটটাকে আরও বাস্তবসম্মত ভাবে সাজাতে পারত না? পারত। কিন্তু সাজায়নি। এরও অনিবার্য কারণ ছিল।
আর একটা উদাহরণ দিতেই হয়, যদিও এই প্রসঙ্গে এই উদাহরণ টানতে আমার রুচিতে বাধছে তবু্ও দিতে বাধ্য হলাম। ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর বুড়িশোলের জঙ্গলে ‘কিশানজি’ রাষ্ট্রের হাতে খুন হলেন। রাষ্ট্র যথারীতি এটাকেও ‘এনকাউন্টার’ বলে চালাল। অথচ সংবাদমাধ্যমে আমরা জানলাম কিশানজির দুটি পা পোড়া, একটা চোখ খুবলে নেওয়া হয়েছে, বেয়োনেট দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছে চোয়াল, বাঁ বগলের নীচে তিনটি গুলির ছিদ্র অথচ হাতে কোনও গুলির দাগ নেই। আমরা হৈহৈ করে উঠলাম। রাষ্ট্র কিন্তু মুচকি হাসল। যে আইপিএস অফিসার এই চিত্রনাট্য সাজাল, সে কি এতটাই বোকা? সেকি বুড়িশোলের ওই উঠতি ইউক্যালিপটাস জঙ্গল ছাড়া অন্য কোনও গভীর জঙ্গলে ফেলে আসতে পারত না কিশানজির মৃতদেহ? সেকি পারত না বাঁ হাতে গুলি চালিয়ে কয়েকটা ফুটো করে দিতে? পারত। কিন্তু করেনি। কারণ রাষ্ট্র চায় তার দাপট দেখাতে। সে জানে তোমরা যতই লক্ষ কোটি লোকের মিছিল বের করো না কেন, আমি যা বলব তাই সত্যি। কারণ আমার কথার পক্ষে রায় দেবে আমার বিচারব্যবস্থা, আমার সুরেই সুর মেলাবে আমার অনুগ্রহপুষ্ট সংবাদমাধ্যম। রাষ্ট্র এই বোকামি নামক খেলায় দু’ভাবে জিতল। এক রাষ্ট্র যা বলে তাই অমোঘ বলে প্রমাণিত হবে, আর যারা এখনও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চায় তারা হবে হতাশ। সর্বস্তরে এই হতাশার প্রয়োগ দিয়ে সমস্ত প্রতিবাদকে রুখে দিতে চায় রাষ্ট্র। একে যদি চিহ্নিত করতে পারি তবেই আমরা এগোতে পারব। নাহলে রাষ্ট্র আমাদের…?
অতীশ পাল : চিত্রকর ও সমাজকর্মী। ফোন : +৯১ ৮৭৭৭৫ ৬২০৮৫ (মতামত ব্যক্তিগত)
ছবি ঋণ : ইন্টারনেট
Comments are closed.